দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর উপকণ্ঠে অবস্থিত আমরাই গ্রামের
শতাব্দী প্রাচীন কিছু দুর্গাপুজার ইতিবৃত্ত ।
দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর উপকণ্ঠে অবস্থিত
আমরাই গ্রাম ।বহূ পুরাতন এবং বর্ধিষ্ণু এই গ্রামের লোক সংখ্যাও বিপুল এবং
ক্রম বর্ধমান । প্রতি বছরের মত এবারও শারদোৎসবে মেতে উঠেছেন পারিবারিক এবং
বারোয়ারি পুজোর সব কর্ম-কর্তারা । শতাব্দী প্রাচীন বেশ কয়েকটি পুজোই জাঁকজমক
ভাবে পালিত হয়ে আসছে এই গ্রামে ।বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা
যায় বাবু পরিবারের এবং রায় পরিবারের সাবেকি পুজোগুলির কথা ।পুরাতন নথিপত্র থেকে
জানা যায় বাবু পরিবারের এই পুজো চলে আসছে প্রায় তিনশ বছর ধরে । এই পরিবারের
প্রবীনদের সাথে আলাপ আলোচনায় জানা গেল এ পুজোর সূচনা করেন জমিদার স্বর্গীয়
গোলকনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা তাঁরই সুযোগ্য পুত্র জমিদার
স্বর্গীয় হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ।
প্রতিমা গড়ার যাবতীয় কাজ বিশাল মন্দিরে্র
ভিতরেই সম্পন্ন হয় সেই প্রাচীন কাল থেকেই । ডাকের সাজে একচালা প্রতিমা অপরূপ
মহিমায় মূর্ত হয়ে ওঠে শিল্পীর নিপুন হাতে । ব্যতিক্রম দেখা যায় এখানে লক্ষী-গণেশ ও
সরস্বতী-কার্তিকের অবস্থানে । সচরাচর দেখা যায় মা দুর্গার বাম পার্শ্বে সরস্বতী-কার্তিক
কিন্তু এখানে মা দুর্গার বাম পার্শ্বে থাকে লক্ষী-গণেশ এবং ডান দিকে থাকেন
সরস্বতী-কার্তিক। দুর্গাপুজা ছাড়াও উত্থান, দোল-উৎসব, রথযাত্রা এবং মনসা পুজো
জাঁকজমক সহকারে পালিত হয় এই মন্দিরেই এবং দেবোত্তর সম্পত্তির আয় থেকেই সমস্ত
পুজোর খরচা এখনো চালানো হয় ।
প্রতিটি সাবেকি পূজোর কিছু না কিছু বৈশিষ্ট
থাকেই । জমিদার বাড়ির শতাব্দী প্রাচীন এই সাবেকি পূজোর প্রধান আকর্ষণ
সপ্তশতী হোম অর্থাৎ চণ্ডীর সাতশ শ্লোকই পঠিত হয় মহাষ্টমীর পুণ্য লগ্নে হোম যজ্ঞ সহ
এই পুজোয় । যজ্ঞসমূহের মধ্যে যেমন অশ্বমেধযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ, সেইরূপ স্তোত্রসমূহের
মধ্যে সপ্তশতী চণ্ডীই শ্রেষ্ঠ (স্তবানামপি সর্বেষাং তথা সপ্তশতীস্তবঃ)।
নবপত্রিকা আনার দৃশ্যটিও বেশ মনোমুগ্ধকর ।
ঊষালগ্ন থেকেই শুরু হয় সানাই’এর মাঙ্গলিক সুর । পট্টবস্ত্র পরিহিত যুবকের দল পালকি
ও মঙ্গল কলস নিয়ে যাত্রা করে নবপত্রিকা আনার উদ্দেশে, সঙ্গে যায় বাজনদারের দল এবং
নব-বস্ত্রে সজ্জিত কচি-কাঁচা থেকে শুরু ক’রে সকলেই ।পুকুরটির পরিবেশও বেশ
মনোমুগ্ধকর । প্রাচীন বটবৃক্ষে ঘেরা সুশীতল এক পরিবেশে নবপত্রিকার স্নান পর্ব এবং
আচার অনুষ্ঠান শেষে সকলে মিলে প্রবেশ করে মন্দির প্রাঙ্গনে হিমের পরশ লাগা স্নিগ্ধ
হাওয়ায় ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে সরু মেঠো রাস্তা পেরিয়ে । চন্ডীমন্ডপে তাদের
প্রবেশের পর এ’বাড়ির বউরা বরণ করেন নবপত্রিকা ।কাঁসর, ঘন্টা, সানাই আর উপস্থিত
কুলনারীদের উলুদ্ধনিতে সারা মন্দির প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে ওঠে ।
দেখতে দেখতে চলে আসে বিজয়া দশমী, মাকে বিদায়
জানাবার পালা। মনে হয় এই বিদায় লগ্নে মায়ের কাছে রূপ, জয়, সাস্থ্ব্য, সম্পদ সব
কিছুই চেয়ে নিই । প্রথানু্যায়ী দশমীর দিন সকালে পরিবারের নারী-পুরুষ সকলেই সমবেত
হয় স্তুতি পাঠ অনুষ্ঠানে । সম্মিলিত সুরে পরমারাধ্য দেবী দুর্গতিনাশিনীর কাছে
কামনা করা হয় – রূপং দেহি, জয়ং দেহি, দ্বিষো জহি । সারা চন্ডীমন্ডপ মুখরিত হয়ে ওঠে
সমবেত কন্ঠে নির্বারিত স্রোতের মত উচ্চারিত মন্ত্রে – “চন্দনেন সমালব্ধে, কুমকুমেন
বিলেপিতে, বিল্লপত্রং ক্রীতাপীড়ে দুর্গোহং স্মরণং গত ”।
এরপরেই পালিত হয় এ পরিবারের আর এক বিশেষ
গুরুত্বপূ্র্ণ অনুষ্ঠান – প্রদীপ স্থানান্তরণ । মহাসপ্তমীর পূণ্য তিথিতে
উৎসর্গীকৃত পূণ্য প্রদীপ চারদিন ধরে একনাগাড়ে জ্বলতে থাকা অনির্বাণ শিখাসহ
স্থানান্তরিত করা হয় দুর্গা্মম্দির থেকে পাশেই শ্রীশ্রী লক্ষী-জনার্দনের
মন্দিরে । এই প্রদীপ স্থানান্তরণের গুরুত্বও অসীম এ-পরিবারে ।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পরিবারের
সকল সদস্যবৃন্দ এবং আত্মীয় স্বজন এক ভিন্ন পরিবেশে কাটিয়ে যান পুজোর কয়েকটি দিন
এখানে ।
রায় পরিবারের পুজোও বেশ জাঁকজমক সহকারে পালিত
হয়ে আাসছে কয়েক শতাব্দী ধরে ।নানান আচার অনুষ্ঠান ছাড়াও এখানের বিশেষ আকর্ষণ বিজয়া
দশমীর দিন ব্যাপক আকারে নরনারায়ন সেবা । সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিনদিনই
ছাগবলি হয় এবং দশমীর দিন মধ্যাহ্নে সমস্ত গ্রামবাসী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী
এলাকার সকলেই মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করেন ।
এ ছাড়া সাহা পরিবার, ভট্টাচার্য্য পরিবার এবং
চ্যাটার্জী পাড়াতেও এই পূজা সাড়ম্বরে পালিতে হয়ে আসছে ।
No comments:
Post a Comment