সুইজারল্যান্ড, রোম ও
ফ্লোরেন্স ঘুরে এসে
আমার ভাগ্যে বিড়ালের শিকে ছেঁড়ার মতই এক সু্যোগ এসেছিল অপ্রত্যাশিত
ভাবে আর সেটা হল আমার বিদেশ যাত্রা এবং তা একান্তই আমার ছেলের বিদেশে চাকরি করার সুবাদে
। তাই ঘুরে এলাম ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, ইটালির রোম ও ফ্লোরেন্স শহর । তারই বর্ননা
সংক্ষেপে লিখলাম । যদিও বিদেশের মাটিতে পা রাখা আমার জীবনের বহু দিনের এক স্বপ্ন ছিল
এবং তা বাস্তবায়িত হওয়ায় আমি অভূতপূর্ব আনন্দিত ।
পাশপোর্ট আমার তৈরীই ছিল।
সু্যোগ আসায় ছেলের কাছ থেকে সমস্ত কাগজ-পত্র ও আমার যাবতীয় ডকুমেন্টস দিয়ে ভিসার জন্য
কোলকাতায় আবেদন জানালাম । ১৫ দিনের মধ্যে তা পেয়েও গেলাম । নির্ধারিত দিনে আমি বেরিয়ে
পড়লাম সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবার জন্য । নানান কারণে আমার স্ত্রী’র আর যাওয়া
হয়ে ওঠেনি, তাই আমি একাই বেরিয়ে পড়েছিলাম ।
দমদম থেকে বিমান ধরে পৌঁছলাম
আবুধাবিতে, আবার ওখান থেকে কানেক্টিং বিমান ধরে নামলাম সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিমান
বন্দরে । পৃথিবীর অন্যতম উন্নত ও ব্যয়বহূল দেশ এই সুইজারল্যাণ্ডে প্রবেশ করেই কেমন
যেন এক শিহরণ অনুভব করলাম - “অজানা নতূন ঠাঁই, অপরূপ এক স্বপ্ন সমান”। আমার ছেলে জুরিখ
বিমান বন্দরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল । জুরিখ
বিমান বন্দরটি এতই বড় যেন মনে হচ্ছিল ছোট খাট একটা শহর ।এয়ারপোর্টের ভিতরেও ছোট ছোট
ট্রেন চলাচল করছে, আমাদের এখানে যেমন বিভিন্ন এয়ারওয়েজের বাস চলাচল করে তেমনি । সেখান
থেকে গেলাম মাইগ্রেশন দপ্তরে, সেদেশে ঢোকার অনুমতি পাবার জন্য । তারপর লাগেজ নেওয়ার
জন্য প্রতীক্ষা । সব কিছু নিয়ে বাইরে এসে যতক্ষণ না ছেলের সাথে দেখা হচ্ছিল ততক্ষণ
যেন আমার ধড়ে প্রাণ ছিল না । বিদেশ বিভুঁই জায়গা, সবই অপরিচিত । তদুপরি আমার সাথে ছিল
না কোনই যোগাযোগ করার উপায় । না ছিল সে দেশের অর্থ বা মোবাইল ফোন বা কোন কিছুই ।যাক
ছেলের সাথে দেখা হবার পর নিশ্চিন্ত হলাম । ওখান থেকে আমরা গেলাম গোল্ডেন পাশের দপ্তরে । এই
গোল্ডেন পাশের সুবাদে সারা সুইজারল্যাণ্ডেই বাস, ট্রেন বা নৌকাতে ঘোরার সুযোগ পাওয়া
যায়, সে পাশের জন্য দেওয়া মাসিক কিছু অর্থের বিনিময়ে । এটা আমাদের মত টুরিস্টদের জন্য
এক বিশাল সুবিধা ।
ছেলের সাথে জুরিখ থেকে
ট্রেন ধরে আমরা পৌঁছলাম আমাদের বাসস্থান অল্টেন
শহরে । ছোট্ট শহর কিন্তু কি অপূর্ব তার সৌন্দর্য । চারিদিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা।
জুরিখ থেকে প্রায় প্রতি মিনিটেই ট্রেন ছাড়ে বিভিন্ন প্রান্তে যাবার জন্য । শহর এবং
শহরতলির রাস্তা-ঘাট, আনাচ-কানাচ খুবই পরিস্কার, পরিছন্ন যেন ঝকঝক করছে । সারা রাস্তায়
একটা কাগজের টুকরোও পড়ে থাকতে দেখা যায় না। অপলক নয়নে সব দেখতে লাগলাম । নেই কোন কল-কারখানার
শব্দ, ধোঁয়া বা ডাস্ট । কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের বাসস্থানে । বৌমা
ও নাতি আমাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল । স্নান পর্ব সেরে মধাহ্ন ভোজনের পর
নিয়ে নিলাম একটু বিশ্রাম । দুদিনের জার্নিতে খুবই ক্লান্ত লাগছিল । বিকালে কাছাকাছি
জায়গায় একটু ঘুরলাম । অনেকদিন পর পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা হওয়ায় নানান গল্প-গুজবেই
কখন যেন ডিনারের সময় হয়ে গেল । আশ্চর্য হলাম যখন আমাদের ডিনার শেষ হয়ে গেল তখনও পশ্চিমাকাশে
সূর্য জ্বলজ্বল করছে । গ্রীষ্মে এখানে রাত্রি ৯-৩০এর পর পুরোপুরি সন্ধ্যা হয় । পরদিন
থেকেই শুরু করলাম খুব ভোরে ওঠার এবং বেরিয়ে পড়তাম প্রাতঃভ্রমণে, নৈসর্গিক সৌন্দর্যতায়
ভরা পাহাড়ি এলাকায় । যেদিকে চোখ যেত সেদিকেই চলে যেতাম । বাড়ি এসে প্রাতরাশ সেরে নাতিকে
নিয়ে বের হতাম স্কুলে আর যেদিনগুলি ছুটি থাকত সেই দিনগুলিতে আমি আর আমার ছোট্ট নাতি
বেরিয়ে পড়তাম এই শহরের বিভিন্ন রুটের বাস ধরে নানান জায়গায়, ইচ্ছে মতো । সাথে থাকত
বিস্কুট, ফল, কিছু ড্রাইফুড আর জলের বোতল । এইভাবেই কাটতে লাগল আমার দিনগুলি ।
যেদিকেই তাকাই মনোমুগ্ধোকর
দৃশ্য দেখে মনে হত যেন সৃস্টিকর্তা নিজের হাতে এঁকেছেন এই শহরের প্রতিটি কোণ । সবুজের
তৃণভূমি আর পাহাড়ের বিশালতার হাত ধরে প্রশান্তি আর অপার্থিবতা যেন মর্ত্যে নেমে এসেছে
। প্রতিটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে এলেই যেন মনে হত এখানেই যদি এই প্রকৃতির কোলে থেকে যাওয়া
যেত! হৃদয়ে হিল্লোল তোলা মুগ্ধ করা আবেশ । প্রাণে প্রাণে বেজে উঠত প্রেরণার সুর । সব
মিলিয়ে মনে হত যেন স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতা । বাড়ি ফিরতে যেন মনই চাইত না ।
শান্তি আর প্রাকৃতিক সৌন্দ্রর্যে
ভরা এই সুইজারল্যন্ডে ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা যে শুধু আনন্দ উপভোগ করে তা নয়, দেশটি
দেখে অনেক কিছু জানা ও শেখার অভিজ্ঞতাও অর্জন করা যায় । কি সুন্দর মানুষের ব্যাবহার
। পরিচিত বা অপরিচিত কারোর সাথে পথ চলতি দেখা হলেই তাদের ভাষায় সবাই যেন কুশল বিনিময়
করার চেস্টা করে । হয়ত সে ভাষা আমরা কেউ বূঝি বা বুঝি না কিন্তু চেনা লোককে দেখে তো
অচেনার গাম্ভীর্যে সেখানে কেউই পাশ কাটিয়ে চলে যায় না ।
সোম থেকে শুক্র বার পর্যন্ত
আমার এইভাবেই কেটে যেতে লাগল । কাছাকাছি জায়গায় ঘোরা, বাজার করা, মাঝে মাঝে সুস্বাদু
ডিশ বানানো এসবেই । বসে থাকতাম কবে আসবে সেই শনিবার, উইক এন্ড । প্রায় প্রতি শনিবারেই
আমরা বেরিয়ে পড়তাম নানান জায়গা ঘুরতে । কোথাও বা একদিনেই ঘুরে আসা যেত আবার কোথাও বা
দুদিনে । হয়ত শুক্র বার রাতে বের হয়ে রবিবার রাতে ফিরতাম ।
ইউরোপের সমস্ত দেশগুলির
মধ্যে সুইজারল্যাণ্ডই হল সব থেকে সুন্দর দেশ
। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন পৃথিবীর সব দেশকেই
হার মানায় । পাহাড়, পর্বতমালা, প্রশস্ত হ্রদ,
লেক, ভ্যালি এবং এ্যাল্পাইন বানাঞ্চল ঘেরা এই দেশটিতে যেন উজাড় করা সৌন্দর্যের বাহার
। পাশাপাশি এ দেশে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ট্রেন, ট্রাম, বাস, প্রাইভেট কার, ঘোড়ার গাড়ি,
নৌকা – এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগাযোগ রক্ষা করেছে । তিন চার ঘন্টার মধ্যেই
জুরিখ, বার্ন বা উলজান শহর থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি শহরগুলিতে পৌঁছানো যায় ।সুইজারল্যাণ্ডের
উত্তরে জার্মানি, দক্ষিণে ইটালি, পূর্বে অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিমে স্পেনের বার্সিলোনা
শহর অবস্থিত । সুইজারল্যাণ্ডকে কেন্দ্র করে ইউরোপ ভ্রমণ অনেক সহজ হয় । মাত্র ঘন্টা
দুয়েকের মধ্যেই বিমানে জেনেভা থেকে বার্সিলোনা বা লন্ডন আবার জুরিখ থেকে তিন ঘন্টার
মধ্যে জার্মানির শহরগুলিতে বা অস্টিয়ার ভিয়েতনামেও পৌঁছানো যায় । লজান থেকে তিন ঘন্টার
মধ্যে ইটালির মিলান শহর এবং চার ঘন্টার মধ্যে ফ্রান্সের প্যারিসে পৌঁছানো যায় ।
ছোট্ট এই দেশটিতে ১৮০০শো’র
ও বেশি রেল লাইন রয়েছে । ব্যস্ততম স্টেশনগুলিতে প্রতি মিনিটেই নানান প্রান্তে যাবার
জন্য ট্রেন ছাড়ে । কোন স্টেশনে কোথাও কোন জায়গায় এতটুকু নোংরা দেখা যায় না । ট্রেন
স্টেশনে ঢোকার আগে বা ছাড়ার সময় শোনা যায় না সুতীব্র হর্নের আওয়াজ । সব চেয়ে বিখ্যাত হল সেরমাট থেকে সেন্ট মরিৎস গামী
গ্ল্যাসিয়ার এক্সপ্রেস । বিশ্বের এটি এক অন্যতম সুন্দর রেলপথ । ২০০৮ থেকে এটি ইউনেস্কোর
বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে । এই রেলওয়ের সঙ্গেই রয়েছে একটি সুপ্রাচীন যাদুঘর
। তীব্র গতিতে ট্রেনে চড়ে যাবার সময় চোখে পড়ে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম, যেন স্বপ্নের মত ।
এই গ্রামগুলিতে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে । প্রকৃতি যেন তার ঐশ্বর্য দিয়ে গ্রামগুলিকে
সাজিয়ে তুলেছে । কোথাও বা দেখলাম পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলু কুলু ধ্বণিতে শান্ত শীতল
নদী, আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে কত হাঁস, পাখি ।কখনো কেউ তাদের বিরক্ত করে না । কোথাও বা
ঝর্ণার কলকল ধ্বণি মুগ্ধ করে তুলেছিল আমাদের । মন কিছুতেই ছেড়ে আসতে চাইছিল না । আবার
দেখলাম কোথাও বা সবুজ আস্তরনে ঢাকা বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি । দল বেঁধে চরে বেড়াচ্ছে
গরু, ছাগল, ঘোড়া ও ভেড়ার দল । এখানে উল্লেখযোগ্য হল গরু ও তার গলার ঘন্টা । বিখ্যাত
হিন্দি ছবি “দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে” ছবিটির কারণে সুইজারল্যান্ডের এই গরুর
গলার ঘন্টা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে খুবই পরিচিত । ইন্টারলেকেনে যেখানে এই ছবিটির বেশির
ভাগ দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল সেখানেই এখন স্থাপিত হয়েছে শ্রীদেবীর একটি মূর্তী। সুইজারল্যান্ডের
পর্যটন বিভাগ তাঁর প্রতি সম্মান জানাতেই এই সিধান্ত নেয় । এছাড়াও আরও বহু হিন্দি ছবির শুটিং হয়েছিল এই অঞ্চলে ।
হাজারো দর্শনীয় জায়গার মধ্যে বেশ কিছু জায়গা আমার ৯০দিন মেয়াদের
মধ্যে ঘোরা হয়েছিল ।
কাছাকাছির মধ্যে প্রথমেই আমরা গেলাম জুরিখ শহরে । এটি একটি ছোট্ট শহর । দেখে মনে হবে এই শহরটি ইউরোপের অন্যান্য
শহরের থেকে একটু আলাদা । ছোট-বড় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সহ নানান গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে
এখানে । দেখা যাবে প্রায় চারশ বছর আগের রোমানীয় সভ্যতার নানা চিহ্ন ও ঐতিহ্য । এসবের
পরেও রয়েছে জুরিখে রূপময় লেক এলাকা । বিশাল
লেক, লেকের দুপাশে পাহাড় আর পাহাড়ের পাদদেশে সাজানো বাড়িঘর ।সব মিলিয়ে এক ছবির মত দৃশ্য
। প্রকৃতির এক যেন এক অপরুপ সৃস্টি । রয়েছে অসংখ্য স্পিড বোট । আর লেকের মাঝখানের ফোয়ারাটি
তো এক অনিন্দ দৃশ্য সৃস্টি করে চলেছে । লেকের
ওপারেই রয়েছে সুইজারল্যান্ডের বড় বড় চকোলেট কারখানাগুলি । সব সময়ই চকোলেটের সুগন্ধে
ভরপুর থাকে গোটা এলাকাটি । কেবল কারে উঠে দেখা
যাচ্ছিল উঁচু পাহাড় । সেখান থেকে নিচের এই লেকের দৃশ্য বড়োই সুন্দর । অদুরেই আছে নোবেলজয়ী
বিখ্যার জার্মান লেখক টমাস মানের বাড়ি ও পাশেই তার কবর ।
আল্পস পর্বতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী সত্যিই মন কেড়ে নেয় । তুষার
মুকুট পরা যেন আল্পসের চুড়া, ঝিলমিল করা নীল হ্রদ, এমারেন্ড ভ্যালী, হিমবাহ – সবই যেন
রূপকথার গল্প । এখানেই রয়েছে বিশ্বমানের আন্তর্জাতিক রিসর্ট এবং হাইকিং, বাইকিং, ক্লিম্বিং,
স্কিইং, প্যারাগ্লাইডিং ও স্লেজ গাড়িতে চড়ার আনন্দ । এই আল্পস পর্বতের সব চাইতে উঁচু
চুড়াটির নাম মেটারহর্ন । আইকনিক এই চুড়াটির
উচ্চতা ৪৪৭৮ মিটার। এখানে আছে ঘোড়ায় টানা গাড়ি, কাঠের তৈরি সব বাড়ি, বিশ্বমানের হোটেল
ও রেস্টুরেন্ট । গ্রীষ্মের সময় হিমবাহ স্কিইং,
পর্বতারোহন, সাঁতার ও টেনিস খেলা খূবই জনপ্রিয় এখানে । তবে সব কিছু উপভোগ করতে হলে
লাগবে সময়, ধৈর্য আর আর্থিক সামর্থ ।
সুইজারল্যান্ডের কাছাকাছিই রয়েছে জাংফ্রোজস - গ্রীষ্ম বা শীত উভয় ঋতুতেই ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো জায়গাটির নাম
জাংফ্রো বা জাংফ্রোজস অঞ্চল । রেলপথের বিস্তীর্ণ নেটওয়ার্ক । বরফে ঢাকা পাহাড় ।নয়নাভিরাম
কয়েকটি পর্বত নিয়েই হল জাংফ্রোজস অঞ্চল । সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রেল ভ্রমণ
হল ক্লেইন স্কেইডেক পর্বত থেকে ইগার ও মনচ পর্বতের মধ্য দিয়ে জাংফ্রোজস পর্যন্ত যাওয়া
।এই রেলগাড়িটির তাই নাম জাংফ্রুবান ।
ইন্টারলেকেন - পর্যটন
রিসর্ট হিসাবে এটি একটি জনপ্রিয় স্থান । ঘড়ি তৈরীর কেন্দ্র হিসেবেও এই জায়গাটি বিশেষ
ভাবে পরিচিত । এছাড়া নির্মল বায়ু সেবন ও স্পা ট্রিটমেন্ট জন্য বহূ পর্যটক এখানে বেশ
কয়েকদিন থাকার মনোবাসনা নিয়ে আসেন । পশ্চিমে থুন হ্রদ আর পূর্বে ব্রিয়েঞ্জ হ্রদের কোলে
অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের অন্যতম ভ্রমনাকর্ষণের স্থানই হল ইন্টারলেকেন । পাহাড়ে ক্লাইম্বিং,
হাইকিং, ট্রেকিং, প্যারাগ্লাইডিং, স্কিং – কি না করা যায় এখানে । এখানেই রয়েছে ২৫০
কেজি ব্রোঞ্জের যশ চোপড়ার মূর্তি । ২০১১ সালে যশ চোপড়াকে ‘অ্যাম্বেসাডার অফ ইন্টারলেকেন’
উপাধি দিয়েছিলেন সুইস সরকার ।
মাউন্ট তিতলিস - সমুদ্রতল
থেকে ৩০০০ মিটার উঁচু সুইজারল্যান্ডের পশ্চিম আল্পসের তূষার ধবল তিতলিস পাহাড়ের চুড়ায়
পৌঁছেই কেবল কারে করে যেতে যেতে চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল উপর থেকে Engelberg’র অপরূপ দৃশ্য দেখে। এখানেই রয়েছে
পৃথিবীর সর্ব পথম ঘুরন্ত গন্দোলা – Rotair’এ চড়ার আনন্দ । ঘুরন্ত গোন্দোলার কাঁচের
জানালায় দাঁড়িয়ে আল্পসের উদার শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্য সকলকেই মোহিত করে তোলে । প্রচুর
টুরিস্ট শুধু স্কি করার জন্যই এখানে ভিড় করে । পাহাড়ের উপরেই রয়েছে প্রচুর রেস্টুরেন্ট
যেখানে ভারতীয় খাবারের পসরা সাজানো আছে । সব কিছুই পাওয়া যায় এমনকি চা বা সিঙ্গাড়াও
। তবে একটি সিঙ্গাড়ার দাম ওদেশের অর্থে ৫ ফ্রাঙ্ক অর্থাৎ আমাদের দেশের মূল্যে প্রায়
৩৫০ টাকা । তিতলিসের একদিকে আছে Ice Flyer ।খোলা চেয়ারে বসে অনেকটা উড়ে যাওয়ার মতোই ব্যপার । উজ্জ্বল দিনে তুষারের উপর
রোদ আমাদের চোখ ঝলসে দিচ্ছিল । ঝকঝকে নীল আকাশ স্বচ্ছ দিনে যত দূর চোখ যায় শুধুই তুষার
আর তূষার ।
লুসারন - সুইজারল্যান্ডের
কেন্দ্রীয় অংশের প্রবেশ দ্বারই হচ্ছে লুসারন । এই লেক লুসারনের ছবির মত সুন্দর দৃশ্যাবলী এবং নীচেই আল্পসের চমৎকার সৌন্দর্যই
মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে । এখনও সেখানে একটি কাঠের তৈরি মধ্যযুগীয় সেতু আছে যা ইউরোপের
সবচেয়ে প্রাচীন সেতু । এখানের ভাল রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নিলাম । এখানে আলু
পনীর দিয়ে তৈরি ক্লাসিক সুইস ডিশ আমাদের খুবই ভাল লেগেছিল । ফ্রান্সের আর্কিটেক্ট
Jean Nouvel’এর নকশায় নির্মিত The Futuristic Culture and Convention Centre (KKL)
এই শহরের স্থাপত্যকলার এক উজ্জ্বলতম নিদর্শন ।
জেনেভা - আন্তর্জাতিক
বিভিন্ন সংগঠনের দপ্তর এই জেনেভাতেই অবস্থিত । জেনেভা পরিবেশবাদী পর্যটকদের জন্য এক
আদর্শ স্থান । এই শহরটিকে গ্রিন সিটি বা সবুজ শহর নামেও গাইডরা আমাদের পরিচয় করিয়েছিল
। রয়েছে এখানে বিশাল উদ্যান । আমাদের বেশ কিছুক্ষণ সময় এখানেই কেটে গিয়েছিল ।
বার্ন - যদিও ঘুরে
ঘুরে সেদিন আমরা প্রায় সকলেই খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম তবুও সিদ্ধান্ত হল সুইজারল্যান্ডের
রাজধানী বার্ন শহর না ঘুরলে আমাদের পরিকল্পনা সার্থক হবে না । নানান দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে এক প্রাচীন
ক্লক টাউয়ার যাতে রয়েছে চলন্ত পুতুল । একে Zytglogge বলে ওদের ভাষায় । এছাড়াও এই বার্নে
দেখা যায় মুনস্টার, গোথিক ক্যাথিড্রেল, টাউন হল। ইউরোপের দীর্ঘতম আচ্ছাদিত শপিং এলাকা
যা প্রায় চার মাইল জুড়ে বিস্তীর্ণ । আর শপিং’এর দুর্বলতাতে তো আমরা সবাই অল্প বিস্তর
ভুগি, তাই জিনিসপত্র সব দেখলেই মনে হছিল যেন কিনে ফেলি, কিন্তু দাম সাধ্যের অতীত ।
মন্টিকার্লো নামে খ্যাত লুগানো, লর্ড বায়রন, শেলি ও হেমিংওয়ের মত লেখকদের জন্মস্থান
এখানেই।
এই ভাবেই দিনকয়েক সুইজারল্যান্ডে থাকা এবং কাছাকাছি জায়গাগুলি এক
এক সপ্তাহ ধরে ঘোরাঘুরির পর আমরা বেশ কয়েকজন ভারতীয় (আমার ছেলের সব সহকর্মী)মিলে পাড়ি
দিনাল ইটালির রোম শহরে । জুরিখ থেকে প্লেন ধরে ঘন্টা দুয়েকের পথ । পৌঁছলাম রোমে । পৌঁছেই
যেন এক শিহরণ অনুভব করতে লাগলাম । সেই কবে থেমে শুনে আসছি “In Rome be Roman” । তাই
মনে মনে ভাবতে লাগলাম রোমান হতে পারব তো ! আমরা যে হোটেলে ছিলাম সুন্দর ব্যবস্থা ।
কাছেই পেয়ে গিয়েছিলাম এক ভারতীয় দিল্লির হোটেল । মাংস, ভাত পেট পুরে খাওয়া হল । পরদিন
সকালেই আমরা বের হলাম রোমের নানান দর্শনীয় স্থান ঘুরতে । ওখানে প্রায় সব টুরিস্ট বাসই
দোতলা আর মাথার ওপর কোন ছাদ নেই । প্রকৃতিকে আরও নিবিড় করে পাওয়া গেল যেন । বাসে নিজের
নিজের জায়গায় বসার পরই গাইড সকলকেই দিয়ে দিল ইয়ার ফোন । সিটেই নির্দিস্ট পয়েন্টে লাগিয়ে
শুনতে লাগলাম পথ চলতি সব দৃশ্য বা ভাস্কর্্য্যের
ইতিহাস, স্থাপত্য ও শিল্পকলার বর্ননা । ইটালির
রাজধানি রোম শহরটি তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপত্য, শিল্পকলা ও নানান সভ্যতার চিহ্নে
সমৃদ্ধ । রোম পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য যারা ইউরোপের প্রায় পুরোটাই
শাসন করেছিল একদিন । কলোসিয়াম, গ্লাডিয়েটর, জুলিয়াস সিজার, স্পার্টাকাস, হানিবাল সহ
অসংখ্য ইতিহাসের সাক্ষী এই রোমান সাম্রাজ্য । খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০ সালে গলদের আক্রমণে
রোমানদের তৎকালীন লিখিত ইতিহাস ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কিংবদন্তীর উপরেই গড়ে উঠেছে রোমান
রাজাদের ইতিহাস ।
দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে
প্রথমেই আমরা গেলাম রোমের কলোসিয়াম’এ (৭০-৮২) খ্রিস্টাব্দ । এই শহরের একেবারে
কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটারটি নির্মিত হয়েছিল বিজয়ী রোমান সৈন্যদের
পুরস্কৃত করতে এবং রোম সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা তুলে ধরতে ।বিশাল জায়গা, হাজার হাজার মানুষের
ভিড়। ইতিহাসে পড়া সেই কলোসিয়ামে দাঁড়িয়ে আছি এই ভেবেই কেমন যেন মনে হচ্ছিল । অনেকক্ষণ
থাকলাম, ছবি তুললাম । এর পরেই আমরা গেলাম বিখ্যাত
সেই ভ্যাটিকান সিটিতে । স্বর্গীয়, ও পার্থিব,
অনন্য, অসাধারন, অতুলনীয় সৌন্দর্্যময় শিল্পকলার প্রাণকেন্দ্র হল পোপের দেশ এই ভ্যাটিকান সিটি । আরও দেখলাম ভ্যাটিকান
যাদুঘর । বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালীও বৃহত্তম যাদুঘরটি দেখার রোমাঞ্চ ছিল যেন সবার
চোখেই । হাজার হাজার দর্শনার্থীর সমগম হয় প্রতিদিনই এই যাদুঘরটি দেখার জন্য । এটি বেশ
কয়েকটি ভাগে বিভক্ত । একদিনে সব ঘোরা বা দেখা সম্ভব নয় । চিত্রকর্ম আর সুনিপুন হাতের
সুক্ষ কাজ, হাজার হাজার অবিশ্বাস্য রকমের জীবন্ত ভাস্কর্যগুলো দুপাশে সাজানো রয়েছে
। রয়েছে একের পর এক অত্যাশ্বর্য্য পেন্টিং যার মধ্যে মন কেড়ে নেয় অ্যারিস্টটল, লিওনার্দো
দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো ইত্যাদী সব বিখ্যাত মানুষদের চিত্র কলা ।কাছাকাছি ইটালিয়ান
এক হোটেলে আমরা সামান্য মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নিলাম । আবার বিকেলে ঘুরলাম বেশ কিছু জায়গা
। রোমেরই এক হোটেলে আমরা রাত্রিবাস করলাম ।
পরদিন ট্রেন ধরে আমরা গেলাম ফ্লোরেন্স শহরে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ
থেকে ফ্লোরেন্সের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস । খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রোমান
সামরিক উপনিবেশ হিসেবে ইতিহাস কাঁপানো বহু নারী খুব সাধারন অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন
ইতিহাসের পাতায় । তেমনই এক নারী ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গলের কথা তো আমরা সবাই জানি । নার্সিং
পেষায় কিংবদন্তী ছিল তাঁর নাম । যিনি চোখের ঘুম ও মুখের খাবার অসহায় রুগ্ন মানুষের
জন্য উৎসর্গ করে পৃথিবীর ইতিহাসে কিংবদন্তির
খাতায় নাম তুলেছিলেন । জ্ঞানচর্চা, চিত্রকলা ও স্থাপত্যকলার জন্যও এই শহরটি
বিখ্যাত । তাই এই সব নানান কারণে এই শহরটিকে মধ্যযুগের এথেন্স নামে ডাকা হত । সে সময়
ইউরোপের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসাবেও খ্যাত ছিল এই সমৃদ্ধশালী ফ্লোরেন্স
শহরটি ।
শিক্ষা ব্যবস্থা - সুইজারল্যান্ড কিন্তু শুধুই বেড়াতে যাওয়া বা প্রকৃতির
অপরূপ সৌন্দর্্যের জন্যই বিখ্যাত নয় । উচ্চশিক্ষা, অর্থনীতি এবং নানান বিষয়ে পড়াশোনা
করার জন্য রয়েছে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলি ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং এর উপরের সারিতে
স্থান পেয়েছে । উল্লেখযোগ্য ETH Zurich, University of Geneva, EPFL, Uni Lussane,
Univ. of Zurich, Bern ইত্যাদী । এই দেশে সেল্ফ ফান্ডিং এ পড়াশোনা করতে যাওয়ার চিন্তা
করাটা আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অকল্পনীয় বলা যায় । রাজনৈ্তিক স্থিতিশীলতা
এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের নানান সুযোগ সুবিধার জন্য বিশ্বের অনেক শিক্ষার্থী এখন পাড়ি
জমাচ্ছে এই সুইজারল্যান্ডে । তবে ইংরাজীর পাশাপাশি জার্মান, ফরাশি অথবা ইটালিয়ান যে
কোনো একটি ভাষায় দখল থাকলে ওখানে থাকার অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় ।
অর্থনীতী – এই দেশটির
অর্থনীতী খুবই স্থিতিশীল । দীর্ঘমেয়াদী মুদ্রা নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এই
দেশটির অর্থনৈতিক নীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট । এখানের মুদ্রা হল ফ্রাঙ্ক (FRANC বা
CHF) । জার্মান বা ইটালিতে অবশ্য এই ফ্রাঙ্কের প্রচলন নেই, ওখানের মুদ্রা হল ইউরো ।
বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় ৭০ টাকায় ওদেশের এক ফ্রাঙ্ক বা এক ইউরোর সমান ।
কী ভাবে যাবেন – দুর্গাপুর
থেকে বা বর্ধমান থেকে দমদম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গিয়ে প্লেন ধরে দিল্লী হয়ে কিংবা
আবুধাবি বা দুবাই থেকে কানেক্টিং বিমানে পৌঁছানো যাবে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিমান
বন্দরে। এখন অবশ্য অন্ডাল বিমান বন্দর থেকে দিল্লী হয়ে কানেক্টং ফ্লাইট ধরেও যাওয়া
যায় । মোট সময় লাগে ১৫ থেকে ১৭ ঘন্টার মতো, মাঝের হল্টিং সময় সহ । দুর্গাপুর, বর্ধমান
বা কোলকাতায় বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্ট রয়েছে যারা এই ইউরোপ যাবার সমস্ত ব্যবস্থাই করে
দেয়, প্রয়োজনে থাকা খাওয়া সহ ।
কোথায় থাকবেন – সারা
শহর জুড়েই রয়েছে অজস্র হোটেল । মান অনু্যায়ী ঘর ভাড়া ১২ হাজার টাকা থেকে ৩০ বা ৩৫ হাজার
টাকার মতো । খাওয়ার খরচা আলাদা । সব হোটেলেই এখন কম্পলিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট দেয় । সেখানে
সব রকমের এবং অঢেল খাবার থাকে ব্রেকফাস্ট জাতীয় । পেটপুরে খেয়ে নিতে পারলে অনেকক্ষণ
থাকা যায়। বিখ্যাত কয়েকটি হোটেল যেমন = ZURICH
HOTEL, ZERMATT HOTEL, SAAS-FEE HOTEL, GENEVA HOTEL ইত্যদী । বহু শহরেই এখন
ভারতীয় খাবারের হোটেল পাওয়া যায় । তাছাড়া আমার মতো ছেলে মেয়ের কাছে বা অন্যান্য আত্মীয়
বা বন্ধু-বান্ধবদের কাছে থেকে ঘুরতে পারলে তো ভালই ।
দেখতে দেখতেই তিন মাস কেটে গেল । আমার ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষের
মুখে । এবার শুরু হল বাড়ি ফেরার পালা । খুব খারাপ লাগতে লাগল । অতিরিক্ত সময় থাকার
কোনই উপায় নেই । ফেরার সময় সকাল বেলাতেই আমার প্লেন ছিল । ছেলে আমাকে জুরিখে পৌঁছে
দিয়ে চলে গেল ।ওখান থেকে এলাম দিল্লী । সেখান থেকে প্লেন ধরে নামলাম পরদিন দমদম বিমান
বন্দরে
সমাপ্ত হল আমার বিদেশ ঘোরার কাহিনী ।
কাঞ্চন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
আমরাই, দুর্গাপুর-৩।
বর্ধমান ; (মো) ৯৪৩৪১১৪৭৩০।
No comments:
Post a Comment