হেমন্তে
কোন বসন্তেরই বাণী
- কাঞ্চন কুমার চট্টোপাধ্যায়
শীত, গ্রীষ্ম আর বর্ষা এই তিনটি
ঋতুই হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন আমাদের প্রধান ঋতু । গ্রীষ্মের দাপটে বর্ষা কেঁদে ফেলে, শরৎ
আসে কাশ ফুলের উপহার নিয়ে বর্ষার অভিমান ভাঙ্গাতে, হেমন্ত আনে শিশিরের গয়না, শীত ঢেকে
দেয় কুয়াশার আঁচলে । ক্ষণ বসন্ত তো ধর্তব্যেই আসেনা, কখন আসে আবার কখন চলে যায় আমরা
যেন জানতেই পারিনা । উপভোগ করতে না করতেই শুরু হয়ে যায় গ্রীষ্মের দাপট । কিন্তু সব
চেয়ে দুঃখের কথা বর্তমানে আমরা যেন হেমন্ত ঋতুকে ভুলতেই বসেছি । মুখচোরা হেমন্ত বাঙ্গালির
ঋতুচক্র থেকে যেন হারিয়েই যেতে বসেছে ।কার্তিক আর অঘ্রহায়ন এই দুই মাস নিয়েই হেমন্তকাল
। শরৎ ও শীতের মাঝে এই হেমন্ত ঋতুটি বিশেষ ভাবে উপলব্ধিই করা যায় না এখন । কিন্তু এমন একটা সময় ছিল আমাদের জীবনে যখন হেমন্তকালে
পালন করা হত নানান লোকাচার বিশেষ করে বাঙ্গালির সংস্কৃতির অন্যতম বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ
অনুষঙ্গ । কার্তিক মাসে কালীপুজো, জগধাত্রী পুজো, ছট, কার্তিক পুজো ইত্যাদী নানান পুজো
পার্বন ছাড়াও এই কার্তিক মাসে বিশেষ ভাবে মনে পড়ে নানান রীতি বা লোকাচারগুলির কথা ।
প্রথমেই মনে পড়ে টহল গানের কথা । আমরা এই গ্রামাঞ্চলে ছোট থেকেই ঘুমঘোরে শুনতে পেতাম
আমাদের সারা গ্রামে টহল গান গেয়ে যাচ্ছে আমাদের পাশের কাণ্ডেশ্বর গ্রাম থেকে আসা বৈরাগীদের
গান । করতাল বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে সারা গ্রাম কাক ভোরে ঘুরে বেড়াত । তখন
হয়ত এই টহল গান আমাদেরকে বিশেষ ভাবে আকৃ্ষ্ট করত না কিন্তু এখন তার অভাব আমরা যেন সবাই উপলব্ধি করছি ।
আর একটা লোকাচার তখন দেখতাম আমাদের
গ্রামের প্রায় সব মেয়েদের মধ্যে ।আমার দিদি, বোন ও তাদের সব সঙ্গীসাথি মিলে শুরু করত
মাড়ুলি দেওয়া । কাকা ভোরে প্রায় সবাই উঠে পড়ত
এবং পৌঁছে যেত মূলত দেবস্থান গুলিতে যেমন চণ্ডীমণ্ডপ, লক্ষীজনার্দনের মন্দির,
বাসন্তী তলা ইত্যাদী জায়গায় । সেখানে এই কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হত এই
মাড়ুলি দেওয়া । প্রতিদিনই তারা তাদের নিজে নিজের মাড়ুলিগুলির উপর মাড়ুলি দিয়ে যেত ।
এই ভাবে সারা মাস দিতে দিতে মাড়ুলিগুলি একটি পুরু স্তরে পরিণত হত । তাছাড়া প্রতিদিন
সেই ভোরে দেওয়া মাড়ুলিগুলির উপর তারা রাখত খেজুর পাতার শিরগুলি সরু সরু করে কেটে দাঁতনের
মত করে ।তাদের ইষ্ট দেবতা প্রত্যুষেই সেই দাঁতন দিয়ে মুখ ধোবেন, এই কল্পনা করেই এগুলি
রাখা হত । এখানেই শেষ ছিল না । এর পর ছিল তাদের মধ্যে নানান খুনসুটির পালা । যারা বা
যে দল একটু দেরি করে উঠে মাড়ুলি দিতে যেত তাদেরকে আগের মাড়ুলি দেওয়া দল গানের সুরে
ব্যাঙ্গ করত – “কাক করে কা কা, বাসি মাড়ুলির মাথা খা” । এতেই ছিল তাদের আনন্দ বা মজা
।আবার এই কার্তিক মাসের প্রতি সন্ধ্যাতেই দেখতাম সেই দলগুলি আবার বের হত নিজের নিজের সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে নিয়ে । প্রত্যুষে
দেওয়া মাড়ুলিগুলির উপর তারা এই সন্ধ্যাপ্রদীপগুলি
জ্বেলে দিয়ে আসত । সাধারনত এইসব প্রদীপগুলি তারা প্রায় নিজেরাই বানিয়ে নিত এঁটেল মাটি
দিয়ে । এইভাবে সারা মাস চলতে চলতে এই কার্তিকের সংক্রান্তির দিন খুব ভোরে উঠে তারা
তাদের মাড়ুলিগুলির যে কোন একটি অক্ষত ভাবে তুলে মাথায় নিয়ে তার উপর জ্বলন্ত প্রদীপ
রেখে পুকুরে ডুব দিত । এটাই ছিল তাদের সমাপ্তি
অনুষ্ঠান বা বা এই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি
দিবস ।যেমন ভাদ্র মাস কেটে যেত এই গ্রামাঞ্চলে ভাদু গান গেয়ে তেমনি এই কার্তিক মাস
কাটত এই প্রদীপ আর মাড়ুলি নিয়ে।
এই কার্তিকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রথা ছিল আকাশ প্রদীপ জ্বালা । আমাদের গ্রামাঞ্চলে বলত স্বর্গবাতি । আজও হয়ত কোথাও
কোথাও দেখা যায় এই রীতি । কিন্তু এই শিল্পাঞ্চলের গ্রামগুলিতে এই আকাশ প্রদীপ এখন আর
জ্বলতে দেখা যায় না । সে সময় আমাদের অনেকের বাড়িতেই দেখতাম আকাশ প্রদীপ নিজেরাই তৈ্রি করে নিত নানান রঙের কাগজ দিয়ে । সরু সরু বাঁশের
কাঠি দিয়ে কাঠামো তৈ্রি করে এই কাগজগুলি আঠা দিয়ে লাগান হত। সব কোনগুলিই বন্ধ থাকত
শুধু উপরটি খোলা থাকত ভিতরে জ্বলন্ত প্রদীপটি বসানোর জন্য আর তার শিখার তাপটি বাইরে
বের হওয়ার জন্যও । প্রতি সন্ধ্যায় একটি লম্বা বাঁশের ওপর সেই জ্বলন্ত প্রদীপটি দড়ি
দিয়ে পতাকা তোলার মত করে তুলে দেওয়া হত । সারা রাত প্রায় জ্বলত সেই প্রদীপগুলি । নানান
রঙের কাগজগুলি দিয়ে সেই জ্বলন্ত প্রদীপগুলি দূর থেকেও দেখা যেত আর খুব সুন্দর লাগত
দেখতে । তখন তো LED আলোর এত দাপট ছিল না, তাই অন্ধকার রাতে এই আকাশপ্রদীপের শোভা আমাদেরকে
ছোটবেলায় খুব আকৃষ্ট করত । লোকবিশ্বাস কার্তিক মাসে এই প্রদীপ জ্বালালে পুর্বপুরুষের
আত্মা নাকি শান্তি পায় । সেই বিশ্বাস থেকেই হয়ত এসেছে এই আকাশপ্রদীপ বা স্বর্গবাতি
জ্বালানোর রীতি । বৈঙানিক দৃষ্টিভঙ্গি যদিও একটু আলাদা । কালীপুজোর সময় প্রদীপ জ্বালানো
বা এই আকাশ প্রদীপ জ্বালানো পোকামাকড় যাদের শ্যামা পোকাও বলা হয়্রে থাকে তাদেরকে এই আগুনের আলোয় আকৃষ্ট করে
পুড়িয়ে মারার জন্যই জ্বালানো হত । এখন তো নানান ধরনের এল।ই।ডি আলোর কেরামতি তাই দীপাবলীতে
প্রদীপ জ্বালানোর রীতি তো প্রায় অবলুপ্ত ।
এছাড়া
হেমন্ত মানেই তো পাকা
ধানের ঋতু। হেমন্ত
আসলেই পাকা ধানের
সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত
হয় বাংলার মাঠ
ঘাট প্রান্তর। খুশির
আলো বয় কৃষকদের
ঘরে ঘরে, চারিদিক
হয় উৎসবমুখর। গ্রাম
বাংলা সেজ়ে ওঠে নতুন রূপে ।হেমন্তের
হিম বাতাস কনকনে
শীতের আগমনী বার্তাও
ঘোষণা করে। এই
সময়ে প্রকৃতি এক
নতুন সাজে সেজে
উঠে। নবান্ন উৎসবেরও
সূচনা হয় ফসল
কাটাকে কেন্দ্র করে।
No comments:
Post a Comment