আমার
মামার বাড়ির সম্বন্ধে দু-চার কথা
- কাঞ্চন
কুমার চট্টোপাধ্যায়
কথায়
বলে মামার বাড়ির আবদার ।আমাদের জীবনে সচরাচর এই কথাটি দ্বৈত অর্থে ব্যবহৃত হয় । আজও
মানুষ কোন অন্যায় আবদার করলেই শোনা যায় “এটা
মামার বাড়ির আবদার নয়” ।আবার মামার বাড়ির আবদার ফেলে দেওয়ারও নয় । যদিও সবার ভাগ্যে
এই মামার বাড়ির আবদার হয়তো জোটে না তবুও মানুষের জীবনে এখনও মামার বাড়ির আবদারের গুরুত্ব
বা কদর অপরিসীম ।
যাই
হোক হটাৎ আমার খেয়াল হল আমার মামার বাড়ি সম্বন্ধে কিছু লেখার । আমার এটাও মনে হল এই
লেখার এটাই যথার্থ সময় কারণ আস্তে আস্তে আমাদেরও বয়স বেড়েই চলেছে অপর দিকে অণু পরিবারের
চাপে আমার মামার বাড়িও খণ্ড বিখণ্ড হতে চলেছে, অবশ্য শুধু মামার বাড়িই নয়, এটাই এখন
রীতি, সর্বত্র এই একই চিত্র ।
প্রথমেই
আমার মামার বাড়ির ভৌগলিক অবস্থান সম্বন্ধে একটু বর্ননা দিই । এটি বাঁকুড়া জেলার মেজিয়া
থানার অর্ন্তগত একটি গ্রাম যার নাম ইকড়া
। গ্রাম বলতে প্রকৃত
অর্থেই গ্রাম । জল, আলো, রাস্তা – কিছুই ছিল না তখন । রানীগঞ্জের
নদী ঘাট থেকে নৌকো করে পারাপার করতে হত এপার ওপারে । ওখান থেকে মেজিয়ায় বাস ধরে যেতে
হত আমার মামার বাড়ির এই গ্রামে । দুপাশে বড় বড় গাছের ছায়া ঘন সরু একফালি রাস্তা, কোথাও
বা পড়ত জোড়া পুকুর কোথাও বা টলটলে জলে শালুক পদ্মে ভরা ছোট ছোট জলাশয় । বাসে যেতে যেতে
কদাচ কখনো দেখা যেত অপর দিক আসা কোন বাস বা ট্রাক কিংবা অন্য কোন ছোট গাড়ি । দ্বিচক্রযান
প্রায় চোখেই পড়ত না । মানুষ বা যানবাহনের তখন এত গতিও ছিল না । বাসে উঠে বসে পড়লেই
হল, একসময় ঠিক পৌঁছে যাওয়া যাবে তাঁদের গন্তব্যস্থলে, এই মনোবাসনা নিয়েই তখন মানুষজন
যাওয়া আসা করত । তখনকার মানুষজনের ছিল অসীম ধৈর্য্য, হাতেও থাকত অফুরন্ত সময় । বাড়ি
গিয়ে কোনই কৈফিয়ত দিতে হত না, কেনই বা এত দেরি বা অন্য কিছু নিয়ে । প্রায় সবার জীবনই
যেন ছিল শান্ত, নিস্তরঙ ।
এতক্ষণ
অনেক ভূমিকা হল, এবার আমার অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির কথায় আসি । খুব ছোটবেলার কথা তো আর মনে পড়ে না, তবে যতদুর মনে পড়ে সেই অভিজ্ঞতার কথাই
লিখি এবার । আমার মামা বাড়ির দাদুরা ছিলেন দুই ভাই । স্বর্গীয় অমরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়
ও স্বর্গীয় ননীগোপাল বন্দোপাধ্যায় ডাক নাম মাগারাম বন্দোপাধ্যায় । দিদিমারা হলেন স্বর্গীয়
মায়া রাণী বন্দোপাধ্যায় ও স্বর্গীয় মতুবালা বন্দোপাধ্যায় । যদিও আমরা কেউই আমার মায়ের
বাবা বা মা কাউকেই দেখিনি । মামার বাড়ির দাদু দিদিমা বলতে আমরা স্বর্গীয় ননীগোপাল বন্দোপাধ্যায় ও স্বর্গীয়
মতুবালা বন্দোপাধ্যায় অর্থাৎ মায়ের কাকা ও
কাকীমাকেই দেখি । কিন্তু তাঁদের ভালোবাসায় আমরা কখনো বুঝতে পারিনি যে তাঁরা আমার মায়ের
কাকা ও কাকীমা অর্থাৎ বাবা – মা নয় । এতটাই
ছিল তাঁদের টান মায়া । আমার মা’রা ছিলেন দুই ভাই বোন আর মায়ের কাকার তরফে ছিল দুই ভাই
ও দুই বোন । আমার ময়ের নাম গায়ত্রী আর মামার
নাম বাথান, আর ওদিকে দুই মামা একজন রথীন্দ্রনাথ অর্থাৎ ফটিক মামা আর শান্তি মামা ।আর
ছিল দুই মাসী – নমিতা মাসি আর জয়া মাসি । এদের সকলকে নিয়েই ছিল আমার মামার বাড়ি । সুখ
শান্তিতে ভরা এক একান্নবর্তী পরিবার । তখন নাতি নাতনী বা ভাগ্নে ভাগ্নি বলতে
আমি আর আমার দিদি । আমার বোন পারু তখন খুবই ছোট । ফটিক মামা বা মাসীদের তখনো বিয়েই
হয়নি । শান্তি মামা তো আমার থেকে বয়সে একটু ছোট । আমার মামারও তখন সবে বিয়ে হয়েছে আমার
মেজপিসিমার বড় মেয়ে মৃদুল’দির সঙ্গে ।তাই আমরা মামীমাকে দিদি বলেই ডাকতাম ।
যেহেতু মামার মায়ের বাবা ও মা কাউকেই আমরা দেখিনি
তাই তাঁদের আদর যত্ন থেকে আমরা ছোট থেকেই বঞ্চিত । আমার দাদু ঈশ্বর অমরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়
ছিলেন বাঁকুড়া জেলার মালিয়াড়া গ্রামে হাই স্কুলের
প্রধান শিক্ষক । এছাড়াও তাঁর খ্যাতি ছিল সাহিত্য ও কবিতা লেখায় । বিদ্রোহী কবি কাজী
নজরুল ইসলাম এবং শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন দাদুর সহপাঠী । দাদুর কবিতা লেখার সুত্র
ধরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’এর সঙেও তাঁর পরিচিতি ও পত্রালাপ ছিল, যার প্রমাণ স্বরুপ
আমরা পাই বেশ কয়েকটি চিঠি । তবে দাদুর এই সব মূল্যবান পত্রাদি ও তাঁর পাণ্ডুলিপি শুনেছি চোরে আরও অন্যান্ন জিনিসের সাথে চুরি ক’রে নিয়ে চলে যায় এবং রাস্তার মাঝে সব নস্ট
ক’রে দেয় কারণ তারা তাদের পছন্দ মত জিনিস না পাওয়ায় । বাকি যা সব ছিল তা আর নানান কারণে
প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি ।
এবার
আমার মামার বাড়ি আসার কথা বলি । আমরা তখন খুবই ছোট । আমি, দিদি, পারু ও পাটু আমরা সবাই একসঙ্গে মা
বাবার সাথে মামার বাড়ি আসতাম । তখন তো আর এত গাড়ির প্রচলন ছিল না । তাই গাড়ি বলতে আমাদের
নিজস্ব গরুর গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা । আগের দিন মুনিষ’কে বলে দেওয়া হত তৈরি থাকতে ।
গাড়ির ওপর খড়, সররঞ্জি বিছিয়ে মাথায় ছতরি দিয়ে আমাদের সকলকে নিয়ে গাড়ি রওনা দিত আস্তে
আস্তে কাদারোড মোড়ে । ওখানটাই ছিল আমাদের যে কোন জায়গা যাওয়া আসার একমাত্র সঙমস্থল
। কাদারোডে আসার আগে থেকেই আমরা দেখতে পেতাম
দু-চারটি বাস বা অন্য গাড়ি । তখন থেকেই আমাদের মনে একটা চাঞ্চল্য ভাব আসত রাস্তায় গাড়ি
ঘোড়া দেখে ।ধীরে ধীরে বাবা আমাদের সকলকে পার করে দিত রাস্তার ওপারে । আমরা অধীর আগ্রহে
অপেক্ষা করতাম কখন আমাদের বাস এসে পৌঁছয় । দূর থেকে রানীগঞ্জের বাস দেখতে পেলেই বাবা
আমাদের সতর্ক ক’রে দিতেন যে বাস আসছে । আমরা ধীরে ধীরে উঠে বসতাম । তখন তো বাসে লম্বা
লম্বা সিট থাকত অবশ্যই মহিলা পুরুষ আলাদা আলাদা । আমরা কোন রকমে বসে পড়তাম, জায়গা খালি
থাকলে । চলতে থাকত বাস সম্বুক গতিতে ।রানীগ্ঞ্জ বাজার, স্টেশন মোড় পার করে বল্লভপুর
পেপার মিল পেরিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়াত নদী ঘাটে
। তখন তো আর ব্রিজ হয় নি । তাই নদী পার না করে কোনভাবেই মেজিয়া ঘাটে আসা যাওয়ার উপায়
ছিল না । বাবা নৌকোর টিকিট কেটে নিয়ে এলে আমরা উঠে পড়তাম নৌকোয় । উঠেই মা শুরু করতেন
ঠাকুর নাম । শুরু হত দামোদর নদীর জল আমাদের সবার মাথায় ছিটানো । কারণ তখন কিছুই বুঝতাম
না, কিন্তু মাথা পেতে সেই জল সাবাই মায়ের কাছ থেকে নিতাম । একটা নৌকোয় অনেক লোক উঠতো
। আস্তে আস্তে নৌকা এসে পড়ত এপারে । এখান থেকেই শুরু হত অন্য রকম অভিজ্ঞতা । নৌকো কিন্তু মেজিয়ার একেবারে এপারে এসে ভিড়ত না
। প্রায় এক কোমর জল থাকতে নৌকো দাঁড়িয়ে পড়ত । কারণ সেখানে নৌকো নোঙ্গর করার কোন ব্যবস্থা
ছিল না বা নৌকা ভেসে থাকার মত জলও থাকত না । অতএব নারী পুরুষ সকলকেই বেশ খানিকটা জলে
নেমে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে বাক্স প্যাঁটরা চটী জুতো হাতে নিয়ে সেই জলটুকু
পেরিয়ে এপারে উঠে আসতে হত । আমাদের বা আরো কিছু কিছু মানুষের জন্য কিন্তু একটু অন্য
রকম ব্যবস্থা থাকত । নৌকোর কাছাকাছি পর্যন্ত গোরুর গাড়ি নিয়ে হাজির বা মোতায়েন থাকতেন
আমার মামা অর্থাৎ ফটিক মামা । আমরা কোনরকমে
নৌকো থেকে নেমে উঠতাম সেই গরুর গাড়িতে । গরু তো আর একহাঁটু জলে চলবে না, তাই সব কারিগুরি
থাকত ফটিক মামার ওপর । গরু কিছুতেই যাবে না আর মামা সেই গাড়োয়ানের সাথে পাল্লা দিয়ে
গরুর গাড়িটি এগিয়ে নিয়ে যাবার আপ্রাণ প্রচেস্টায়
ব্যস্ত থাকত । আর আমার মা বিশ্বের যত দেব দেবী আছেন সকলকে নিরন্তর ডেকে যেতেন
এই স্বল্প রাস্তাটুকু নিরাপদে পার ক’রে দেবার জন্য । আর বাবা তখন যেন অন্য মানুষ ।
সেই গাড়িতে এতগুলি প্রাণ নিয়ে সেই অবস্থায় সম্পুর্ণ মামার ওপর নির্ভরশীল হয়ে বিপদ সংকুল
অবস্থায় মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে মামাকে বলতেন, “ফটক্যে, তুই আমাদের সবাইকে দিলি মেরে”
। তখন রাগে মামার নামটা অপভ্রংশ হয়ে ফটিক থেকে ফটক্যে হয়ে যেত । আর মামার অবস্থাখানা
যে কি হত, তা আর বলার থাকত না । তবুও তাদের মধ্যে ছিল প্রাণ, ছিল অন্তরের টান, ভক্তি,
দায়িত্ব বোধ, কর্তব্যপরায়নতা ।
তারপর আমরা সেই গরুর গাড়িটিতে উঠে এসে আমরা থামতাম
মেজিয়ায় ফটিক মামার সুপরিচিত শিশির বাবুর মিষ্টির
দোকানে । সেখানে আমাদের সবার হালকা জলোযোগের পর মামার বাড়ির জন্য্ মিষ্টি ইত্যাদী নিয়ে
গাড়ি আবার রওনা দিত । আস্তে আস্তে মায়ের সব পরিচিত জায়গা পার ক’রে আমরা এসে পৌঁছতাম
মামার বাড়িতে । ওহ সে কি দৃশ্য বলে বোঝানো যাবে না । তখন এই গ্রামের পরিস্থিতি ছিল একেবারেই অন্যরকম ।গ্রামের সবাই ছিল যেন এক সুত্রে বাঁধা
। আপন পর বলতে কিছুই ছিল না, সবাই যেন সবার আত্মীয় । তখন একটা রেওয়াজ ছিল বিশেষ ক’রে
ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে কারো বাড়িতে কেউ এলে সাথে সাথে সবাই হাজির হত তাদের বাড়িতে
তাদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে । সবার বাড়িতেই আত্মীয় স্বজন এলে মিষ্টি নিয়ে যাবার
রীতী তো ছিলই, তাই বাড়ির গৃহিনী সব ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে কিয়দংশ মিষ্টিও ভাগাভাগি
করে দিতেন, আর তারাও খুশি হয়ে সেই মিষ্টি নিয়ে সবার সাথে দেখা করে বড়দেরকে প্রণাম করে
তাঁদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে তারা তাদের বাড়ি ফিরত । এমনই ছিল সে-সময় সেখানকার মানুষের
মধ্যে অগাধ ভালবাসা । এখন যা আর প্রায় দেখাই যায় না ।
এরপর শুরু হত আমাদের আপ্যায়নের পালা । আমার দিদিমা তো আমাকে কোল থেকে নামাতেই চাইতেন না । ছোট
বেলায় আমি খুব বোকা বোকা দেখতে ছিলাম । সে সময় আশু গয়লা ব’লে একজন মামার বাড়িতে দুধ
দিত সেও নাকি খুব বোকা বোকা দেখতে ছিল, তাই আমার দাদু দিদিমা সকলে আমাকে ‘অ্যাশো গয়লা’
বলে খ্যাপাত । আমার বাবা ইকড়া গেলে মনে হত
যেন এক উৎসব । খাতির যভ্নের কোনই ত্রুটি দেখতে পাওয়া যেত না । আমার বাবা যা সব খেতে
পছন্দ করতেন, তাই রান্না হত । বাবা গুগলি খেতে
খুব ভালবাসত তাই আমার দুই মাসী নমি মাসী আর জয়ী মাসী নেমে পড়ত সামনের গড়েতে (গড়ে মানে
ছোট জলাশয়) । সেই গুগলি তুলে তার রান্না করে বাবাকে খাইয়ে তবে তারা খুশি হত । দুপুরে
খাওয়া দাওয়ার পর শুরু হত খাঁসি কাটার তোড়জোড় । এই দায়ীত্বে থাকতেন আমার ফটিক মামা ।
মামা বাড়ির ভিতরেই ছিল এক বেল গাছ, সেই বেল গাছে খাঁসি কেটে সেটা ঝুলিয়ে পরিষ্কার করে সব
কিছু রেডি করার বন্দোবস্ত ফটিক মামাই নিপুন ভাবে করতেন ।
তখন ইকড়ায় বিদ্যুৎ আসেনি । তাই হ্যারিকেনের আলোয়
চলত সব কাজ সারা । এমনিতে ওই গ্রামের সকলেই সূর্যের আলো নিবলেই রাতের খাওয়া সেরে ফেলতেন
। তেমনি আবার কাক ভোরে প্রায় সবাই উঠে পড়তেন । এ রকমই ছিল সে সময় সেখানের জীবনযাত্রা
। আমরা যখন যেতাম সেসময়ই খাওয়া দাওয়া সারতে যা একটু রাত্রি হত ।
মামা বাড়ি পৌঁছানোর পর দেখতাম মা আমাদের নিয়ে
যেতেন প্রভাত দাদুর বাড়ি । দিদিমা গতু বালা মা’কে খুব ভালবাসতেন
। একই উঠোনের মধ্যে সবার বাড়ি । তারপর মা যেতেন বাঁকু মামার বাড়ি । বাঁকু মামার মা
পাতু বালা খুব শান্ত ঠাণ্ডা মানুষ ছিলেন । একই গণ্ডির মধ্যে সবার বাড়ি মা যেতেন আবার
কত মানুষ আসতেন মায়ের সাথে দেখা করতে ।ভোলা মামা, সম্ভু, সত্য’দা এরাও থাকত । কিছু
কিছু মানুষকে খুব মনে পড়ে । সেই রকমই একজন মানুষ ছিলেন মথন দাদু, তিনি চিকিৎসাও করতেন
। সেসময় কারো কিছু অসুখ বিসুখ করলে প্রাথমিক ভাবে মথন দাদুই চিকিৎসা করতেন । মায়ের
ডাক নাম ছিল “ কড়ি ”। গ্রামের সবাই মা’কে কড়ি
বলেই ডাকত । তখন মামা বাড়ির আর এক আকর্ষণ ছিল তাদের জোড় । জোড় মানে ছোট একফালি
নদী, শান্ত ভাবে বয়ে চলত এই গ্রামের দক্ষিণ সীমান্তে । কুলু দুলু শব্দে নিজের গতিতে
বয়ে চলেছে এখনো । তখন এই গ্রামে দু-একটা ইঁদারা বা কুয়ো ছাড়া আর কোন ভাবেই পানীয় জল
পাওয়া যেত না । তাই স্নান বা পানীয় জলের জন্য সকলেই যেত এই জোড়ে । কেউ বা সারাদিনে
বহু বার যেত এই জোড়ে শুধু পানীয় জল আনতে আবার কেউ বা একেবারে ওই জোড়ে স্নান সেরে পানীয়
জলটুকু নিয়ে বাড়ি আসত । পানীয় জল আনার পদ্ধতিটি ছিল বড়ই সুন্দর ।সে সময় সেই দৃশ্য দেখতে
আমাদের খুবই ভাল লাগত । সবাই কলসীর সাথে একটি
করে বাটি নিয়ে যেত । এবার সেই বাটি দিয়ে জোড়ের কোন এক পরিষ্কার জায়গায় একটু গর্ত খুঁড়ত,
তাতেই বেরিয়ে আসত পরিশ্রুত জল । তারপর সেই জল বেশ কয়েকবার তুলে ফেলে দিয়ে সেই বাটিতে
করে কলসী ভ’রে জল নিয়ে আসত সবাই তখন । সেই পরিশ্রুত জলের স্বাদ বা গুণগত মানও ছিল অনেক
এবং ছিল ক্ষুধা বর্ধ্যকও । আমার বাবা সেই জল খুব ভালবাসতেন, তাই আমরা গেলে আমার মাসীরা
সারা দিনে বহু বার সেই জল নিয়ে আসত তখন জোড় থেকে । তখনও এই গ্রামে নলকূপের কোন ব্যাবস্থাই
ছিল না । শুধু স্নান বা পানীয় জল আনাই নয়, এই জোড়ে বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় আমাদের বেড়াতে
যেতেও খুব ভাল লাগত । এ ভাবেই দেখতে দেখতে
কেটে যেত আমাদের বেশ কয়েকটি দিন । মামাবাড়ির আদর যত্ন ছেড়ে আমাদের আসতেই ইচ্ছা করত
না ।মামা বাড়ি থেকে ফিরতেও হত আমাদের সেই একই ভাবে ।
আস্তে
আস্তে আমরা বড় হতে লাগলাম । আমাদের আদর যত্নের ধরনে এল একটু পরিবর্তন । দিদিমা’র কোলে
ওঠার দিন শেষ হয়ে গেল । তাদের ঠাট্টা ইয়ার্কির ধরনও পালটে গেল । আমাদেরও পড়াশোনার চাপ
বাড়ল, তাই মাঝে মধ্যে কদাচ কখনো বা যাওয়া হত মামার বাড়ি ।এবার বিশেষ কিছু মানুষজনের
ক্থা একটু লিখি । প্রথমেই লিখি আমার দাদু শ্রদ্ধেয় ননীগোপাল বন্দোপাধ্যায় সম্বন্ধে
কিছু ক্থা । আমার দাদু ছিলেন খুব বিদগ্ধ একজন মানুষ ।তাঁর জীবনমুখী দর্শন ছিল প্রসংশনীয়
। সঙ্গীতে তাঁর খুব ভাল দখল ছিল । ।তিনি খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারতেন, ভাল তবলাও বাজাতেন । আমার দিদিকে গান বাজনায় তিনিই হাতেখড়ি দিয়েছিলেন
। রবীন্দ্র সাহিত্যে তাঁর বিচরন বা দখল ছিল নজর কাড়ার মতো । ছোটবেলায় দেখতাম দাদু রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’ থেকে বহূ ছোট ছোট কবিতা জীবন দিয়ে উপলব্ধি ক’রে প্রয়োগ করতেন
এবং আমাদের শোনাতেন । আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যগ্রন্থের
প্রতি যেটুকু আগ্রহ আমার তা দাদুর থেকেই প্রতিফলিত
। আমার বেশ মনে আছে কতককগুলি ছোট ছোট কবিতা যেগুলি দাদু প্রায়ই বলতেন – “জন্ম মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের
খেলা, যেমন চলার অঙ্গ পা তোলা আর পা ফেলা” আর
একটি যেমন “দিনান্তের মুখচুম্বী রাত্রি ধীরে কয়, আমি মৃত্যু তোর মাতা মোরে কেন ভ্য়”
? সারাদিন নানান পরিশ্রমের পর দাদু যখন একটু বিশ্রাম নিতেন তখন প্রায়ই বলতেন
“সারা
দিন গেল আমার শতেক জঞ্জালে, সন্ধ্যা- কালের পূজা যেন না যায় বিফলে” । একটা
গান দাদু প্রায়ই গুনগুন করতেন “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, ত্যায়াগিলে আসে হাতে” আমার মনে হয় দাদুকে আমরা যেটুকু দেখেছি, যেটুকু সান্নিদ্ধ পেয়েছি, তা মামাবাড়ির আর কোন ভাই বোনরাই পায়নি ।
কারণ তারা তখন খুবই ছোট, কেউ বা নেহাতই স্কুলে
পড়ে । আমার দিদি যখন হয়, তখন সে নাকি খুবই
দুর্বল ও কাহিল হয়েছিল, এমনকি তাকে বাঁচানও মুস্কিল হয়ে পড়েছিল । দাদু এই অবস্থায় মা
ও দিদিকে নিয়ে ইকড়ায় চলে এসেছিল । দাদু দিদিমা’র যত্নে দিদি সুস্থ হয়ে উঠেছিল মাস কয়েক
পরে ।এটা দাদুর কাছে একটা বিশাল গর্বের ব্যাপার ছিল ।
দাদু আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসতেন এবং বেশ কয়েক মাস
থেকেও যেতেন । মা বলত “কাকা বাড়ি গিয়ে কী করবে, আর ক’টা দিন থেকেই যাও” । দাদু মায়ের
অনুরোধ ফেলে দিতে পারতেন না । আমাদেরও বেশ ভাল লাগত । দাদুর কাছে নানান গল্প, নানান কথা বা উপদেশ শোনাও যেত । তখন দেখতাম দাদু আমাদের
বাড়িতে অবসর সময়ে নানান কাজে ব্যাস্ত থাকতেন । সব রকম কাজই তিনি করতে পারতেন । কি কারপেন্টারের
কাজ, কি অন্য কিছু । কখনো দেখতাম শণ দিয়ে দাদু দড়ি পাকাচ্ছেন, কখনো বা অন্য কোন কাজে দাদু ব্যাস্ত
। তখন আমাদের দরজার একটা খিল ভেঙ্গে গেলেও দাদুই সেরে দিতেন । কোন কাজ না পারা হত না
। তখন আমার খুব মনে পড়ে, ১৯৬৮ সাল । আমি তখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি । আমার বাবা যে
কোম্পানীতে চাকরি করতেন সেখান থেকে হঠাৎ বদলি
করে দেয়, কিন্তু তখন আজকের মত হূট ক’রে অন্য রাজ্য বা বিদেশ বিভুঁইয়ে যাওয়া
সম্ভভ হত না । তাই আমার বাবা সেই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নেন । তখন আমাদের একান্নবর্তী
সংসার । আমরা ছয় ভাই বোন । বসে বসে সংসার চালানো বাবার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছিল । তাই
বাবা, কাকা ও দাদু আলাপ আলোচনা করে ঠিক হয়েছিল যে আমাদের একটা বেশ ভাল রকমের বড় দোকান
আমাদের বাড়িতেই খোলার। দাদু সব রকম ব্যবস্থা করা শুরু করলেন । বাইরের দিকে একটা ঘরে
রাস্তার দিকে দরজা কেটে নানান আসবাব পত্র দিয়ে সুদৃশ্য ভাবে সাজিয়ে এক শুভদিনে খোলা
হল আমাদের দোকান । প্রথম প্রথম দাদুই বাবাকে পরামর্শ বা উপদেশ দিয়ে সব কিছু দেখাতে
লাগলেন । রানীগঞ্জ থেকে ট্রাকে ক’রে সব রকম জিনিস পত্র আনা হল ।
একজন বিশ্বস্ত লোক রাখা হল । দোকান বেশ ভাল ভাবেই চলতে লাগল । প্রায় মাস ছয়েক দাদু
আমাদের বাড়িতে একটানা থেকে সব কিছু দেখিয়ে বাড়ি ফিরলেন । কিছু দিন পরই আবার চলে আসতেন দাদু এখানে । তখন আমাদের
বাড়িতে কুয়ো ছিল না । বাবা দাদুকে বললেন । দাদু বললেন ঠিক আছে আমি ইকড়া থেকে লোক নিয়ে
আসব, কুয়ো কাটার জন্য । একদিন দেখি দাদু সব লোকজন নিয়ে হাজির । শুরু হল কুয়ো কাটা ।
দাদুর তত্বাবধানে কুয়ো কেটে সেই জল দেখে দাদু বাড়ি গেলেন সেবারের মত । একবার বাবার
ইচ্ছা হল বাড়িতে ধান সিদ্ধ ক’রে চাল তৈরি করার । সেই ইচ্ছার ক্থা দাদুকে জানানো হল,
দাদু পুরো দল নিয়ে চলে এলেন । শুরু হল চাল তৈরি করার পদ্ধতি ।ইকড়ার বংশী বাউরি, ধীরেন
বাগদী আমাদের বাড়িতে এক্রক্ম বাঁধাই ছিল । যে কোন কাজেই তারা তাদের দলবল নিয়ে দাদুর
কথা মত এখানে হাজির হয়ে যেত । কাকীমায়ের হঠাৎ
মনে হল বাড়িতে যদি একটা ঢেঁকি থাকত তো বাড়িতেই সেই চালের কিছু কিছু কাজ করে নেওয়া যেত
। দাদুকে সেই ইচ্ছার কথা জানানো হল, দাদু কী ভাবে ঢেঁকি বানাতে হয় তা ভাল ভাবেই জানতেন
।নিজে কাঠ কিনে এনে ছুতোর দিয়ে সেই কাঠ দিয়ে ঢেঁকি বানিয়ে আমাদের বাড়িতে বসান করিয়েছিলেন
। তখনো আমাদের বাড়িতে পায়খানা ছিল না । সে
স্ময় গ্রাম এতটাই পিছিয়ে ছিল যে বাড়িতে পায়খানা করার কোন চল ছিল না । এই সব ক্থা ভেবে
বাবা ঠিক করেছিলেন যে আমাদের একটা পায়খানা তৈরি করার । যেহেতু তখনো বাড়িতে পায়খানা করার
চল আসেনি তাই বাবা ঠিক করেছিলেন আমাদের খামারে একটা পায়খানা করার কথা । দাদুকে সে ব্যাপারে
জানানো হলে দাদুর তাদারকিতে বাবা আমাদের জন্য একটা পায়খানা তৈরি করেছিলেন ১৯৬৮ সালে
।এখন অবশ্য আমাদের বাড়িতে বড়িতে সবারই পায়খানা আছে । খামারের পায়খানা ঘ্রটি এখন ধংসপ্রাপ্ত ।
দাদুর
আর একটা বিশেষ গুণ ছিল দাদু ঠাকুরের খুব ভাল ডাক (ডাকের সাজ) বানাতে পারতেন । ইকড়ার
মা দূর্গা’র ডাক দাদু নিজের হাতেই বানাতেন । তখন দেখতাম ভোলা মামা দাদুকে এই ব্যাপারে
খুব সাহায্য করত ।দাদু এই ডাক
শোলা কেটে কেটে বিরজা আঠা এবং আরও নানান উপক্রণ দিয়ে সাজিয়ে তুলতে হত । পরে দাদুকে তন্ময় ও সাহায্য করত । ছোট বেলায় খুব
মনে পড়ে ইকড়ার মা দুর্গার কাছে দাদু চাঁদমালা বানাতেন তাতে লেখা থাকত “বিদ্যা দে মা – হেনা-কাঞ্চন” । আস্তে আস্তে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে দাদু মায়ের ডাক আর বানাতে পারতেন না ।
লিখতে
লিখতে কত কথাই দাদুর সম্বন্ধে মনে পড়ছে তার আর অন্ত নেই। মনে হচ্ছে পাতার পর পাতা দাদুর
সম্বন্ধে লিখে যাই । দাদু তখন সিগারেট খেতেন খুব । তখন দেখতাম প্যাশিংশো বলে একরকমের
সিগারেট পাওয়া যেত । বাবা সেই সিগারেট দাদুর জন্য এনে দিতেন । সর্দি কাশিতে খুব ভুগতেন
দাদু । প্রায়ই তখন কাকার কাছে পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন নিতেন । স্নান তো প্রায় করতেনই না
। একটু সরষের তেল মেখে মাথা ধুয়ে নিতেন ।প্রায়ই দাদুর মাথা ধরত, তাই দাদু কড়া ক’রে
চা আর স্যারিডন কিংবা অ্যানাসিন খেয়ে একটু শুয়ে পড়তেন ।দাদুর ব্যবহৃত একটা মানি ব্যাগ এখন’ও
আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে । আস্তে আস্তে আমরা বেশ বড় হয়ে গেলাম
। দাদু ও বয়সের ভারে আর বড় একটা আসতে পারতেন না । তখন তো আর টেলিফোন ছিল না তাই চিঠি
পত্রের মাধ্যমে খোঁজ খবর নেওয়া দেওয়া হত । এই ভাবে চলতে চলতে একদিন দাদু আমাদের ছেড়ে
চলে গেলেন, ২৫শে ভাদ্র ইং ১৯৭২ সাল ।
দাদু
চলে যাবার পর দিদিমা একা হয়ে গেল, যা হয় । দিদিমা ইকড়াতেই থাকতেন । শান্তি মামার ও
বিয়ে হল । মাঝে মাঝে দিদিমা মামার কাছে দুর্গাপুরেও আসত, আমরা মা’কে নিয়ে সবাই মিলে
যেতাম । খুবই ভালবাসত আমাদের । তারপর দিদিমাও একদিন চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে ২রা বৈশাখ ইং ১৯৯৯ শাল ।
এবার
আসি ফটিক মামার ক্থায় ।ফটিক মামা আমার বাবার থেকে অনেক ছোট । বাবা ফটিক মামাকে খুব
ভালবাসতেন । বাবা তখন চাঁচে চাকরি করতেন । আমরা তখন খুবই ছোট । চাঁচের কোয়াটার্সে আমরা
থাকতাম । তখন খুব আবছা মনে পড়ে ফটিক মামা আমাদের দুজনকে নিয়ে একটা কাঠের তৈরি গাড়ি
করে নিয়ে ওখানে ঘুরত । বাবা একদিন নাকি মামাকে বলেছিল ফটিক দেখি তুই কেমন এক্সপার্ট
হয়েছিস । কিছু পেঁপে নিয়ে (হিন্দিতে পেঁপে
কে পপিতা বলে।) চাঁচের বাজারে বিক্রি করে আয় তো দেখি । আমরা যেখানে থাকতাম সেখানের
গাছে এই পেঁপে গুলো হয়েছিল । মামা সেই পেঁপে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে আসে এবং বাবার
কাছে খুব বাহবা আদায় করেছিল । আরও কত গল্প শুনতাম মামার কাছে এই চাঁচে থাকার সময় ।
আমরা যখন ছোট তখন ফটিক মামার বিয়ে হয়নি । তারপর এক সময় দেখলাম ফটিক মামা ডি এস পি’তে
চাকরি পেল কিছুদিন পর ফটিক মামার বিয়ে হল পায়রাশোলে। আমি, দিদি, আমার বাবা সবাই বরযাত্রী
গিয়েছিলাম ফটিক মামার বিয়েত ইকড়া থেকে গরুর গাড়ি ক’রে । দারুণ আনন্দ হয়েছিল । আস্তে আস্তে মামার বাড়ির সংসার ও বাড়তে লাগল ।
একদিন এভাবেই চলতে চলতে মামা আর ফটিক মামার সংসারও আলাদা হয়ে গেল । শান্তি মামা তখন
ছোট । বেশ কয়েক বছর পর ফটিক মামা দুর্গাপুরে কোয়াটার্সে চলে এল । প্রথম প্রথম ফটিক
মামা আর মানিক’দা (আমার মেজ পিসিমার বড় ছেলে
)এক সাথে ভারতী রোডের একটা বাসায় থাকত । তারপর মামা সকলকে নিয়ে ওই কোয়াটার্সেই থাকতে
লাগল । ওখান থেকে সবাই পড়াশোনা করল তারপর রীতা ও মিতা’র বিয়ে হল l এই দুর্গাপুর থেকেই
। মাঝে মাঝে দিদিমা’ও থাকত । আমি মা ও মঞ্জু পিকুকে নিয়ে স্কুটারে করে মামার বাড়ি বেড়াতে
যেতাম প্রায়ই । আমাদের ওটা একটা বেড়াবার জায়গা ছিল ভাল । কালের প্রবাহে অনেক পরিবর্তন
এসে গেল । দিদির বিয়ে হয়ে গেল । আমি চাকরি পেলাম ডিভিসি’তে । আমারও বিয়ে হয়ে গেল ।
মামার বাড়ি সংগে চিঠি পত্রেই যোগাযোগ হতে থাকল শুধু । মামারও চাকরি থেকে রিটায়ার করার
বয়স হয়ে গেল । বেশ কয়েক বছর পর মামা আবার সকলকে নিয়ে ইকড়াতে ফিরে গেল । আমরা গাড়ি নিয়ে
মাঝে মাঝে যেতাম মামার বাড়ি । সবার সাথে দেখা করে আসতাম । বেশ ভাল লাগত । এইভাবেই চলতে
চলতে মামা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল । চিকিৎসা চলতে লাগল । তারপর একদিন খবর পেলাম মামা আমাদের
ছেড়ে চলে গেলেন ২১/০৮/২০১৪ সালে । খবর
পেয়েই আমি ও মঞ্জু গেলাম মামাকে শেষ দেখা দেখতে
। খুব খারাপ লাগল কিন্তু কিছুই করার নেই । মামা খুব ভালবাসতেন আমাদের । কখনো আমাকে
আদর ক’রে ‘কাঁচু’ ছাড়া ডাকে নি । সেই ভাবে ডাকার আর কেউই রইল না মামা বাড়িতে । দুদিন
ফোন না করলেই মামা ফোন করে বলতেন “কাঁচু, দুদিন
ফোন করনি” । এতটাই মামা আমাদের ভালবাসতেন । আমাদের বাড়ি এলে মঞ্জুর
হাতের রান্না খুব ভালবাসতেন । বেশ কয়েক বছর আমার দু-মামাই ভাইফোঁটার সময় আমাদের বাড়ি
এসে মায়ের কাছে ফোঁটা নিতেন । মঞ্জু রান্নাবান্না ও সব ব্যাবস্থাই করত দু-মামা ও তার
ভাইদের ফোঁটা নেবার জন্য
। আমি সব যোগাড় করে দিয়ে চলে যেতাম আমার দিদি ও বোনেদের বাড়ি ফোঁটা নিতে ।
মামার
সাথে মামীমা’র কথা একটু এইখানে বলি । মামীমা ছিল সংসারের এক আদর্শ গৃহিনী । মামীমা ওই রকম কর্মঠ না হলে মামার
পক্ষে অসুবিধা ছিল অত বড় সংসার ঠিক ভাবে চালানো; তার সংগে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, বিয়ে
দেওয়া নানান কাজ । তখন দেখতাম মামীমা টাউনশিপে থেকেও কোয়াটার্সে মুড়ি ভাজা থেকে শুরু
করে নানান কাজ করতেন নিজের হাতেই । কোনদিন কোন কাজ পারবনা বলেন নি ।কোয়াটার্সেই মামা হাঁস পুষেছিলেন নেহাতই
শখে । মামীমা সব দেখাশোনা করতেন । তখন ‘ক্যাম্বেল’ নামে একধরনের হাঁস পাওয়া যেত যারা
কৃত্রিম জলাশয়ে খুব কম জলেও থাকতে পারত ।এক
ধরনের সবুজ রংএর বড় বড় ডিম দিত এবং এক নাগাড়ে
অনের দিন ধরে ডিম দিত । সেই হাঁসগুলির দেখাশোনাও মামীমা করত । বাসায় বাগানের ভিতরে
সেই ছোট জলাশয়ে আবার ‘ত্যালাপিয়া’ মাছও মামা চাষ করতেন আর মামীমা
ওসব নিজেই দেখাশোনা করত । আস্তে আস্তে মামীমা’রও বয়েস বাড়ল
। কর্মদক্ষতা চলে গেল । ছেলেমেয়েদের এক এক ক’রে বিয়ে হল । তারপর যা হয় । এখন আর মামীমা
সে রকম কোন কাজ কর্ম করেন না । শরীর ও আগের থেকে অনেক খারাপ হয়ে গেছে ।
এরপর
আসি আমার মামা বাথান দাস বন্দোপাধ্যায়’এর কথায় । মামা ছিলেন ইকড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
প্রথান শিক্ষক । বাড়ির কাছেই ইস্কুল ।তাই সেদিক দিয়ে মামার কোন চিন্তা ছিল না । কোন
চাপও ছিল না । খুব কম ছাত্র ছাত্রি নিয়ে ছিল মামার স্কুল । তবে মামার অমায়িক ব্যাবহারের
জন্য মামার জনপ্রিয়তা ছিল সত্যিই প্রশংসা করার মতো । মামাকে চিনত না এ রকম মানুষের
সংখ্যা খুবই কম ছিল । মামার সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল খুব মিষ্টি মধুর । ঠাট্টা তামাশা
সবই চলত মামার সাথে । বাইরের কেউ প্রথম প্রথম দেখে অবাক হয়ে যেত ।কাকার সাথে সম্পর্ক
ছিল বন্ধুর মত । কাকা আর মামা প্রায় সমবয়সী ছিল, তাই । বাবাকে মামা খুব ভয় করত । মায়ের
যখন বিয়ে হয় তখন মামা খুব ছোট ছিল । সবে হয়ত গোপনে ধুমপান শুরু করেছে । বাবা যখন মামাকে
সিগারেট আনতে দিত, মামা তখন সেই প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে নিত । বাবা যখন
বলত “বাথান, প্যাকেটে যে ন’টা সিগারেট রয়েছে, মামা তখন নাকি বলত আজকাল একটা প্যাকেটে
ন’টা করেই সিগারেট থাকছে” । বাবা সব কিছু বুঝে মুচকি মুচকি হাসত । দাদুর বয়স হয়ে যাবার
পর মামাই আমাদের সংসারের প্রায় সব রকম দায়িত্ব
গ্রহণ করেছিল, ছোট বেলা থেকেই তাই দেখতাম । আমার বেশ মনে পড়ে, আমার পৈতের সময়
সব দায়িত্ব আমার দাদু আর মামা নিয়েছিল । ঠাকুর (রাঁধুনি) আনা, মিষ্টির জন্য ছানা আনা,
সব কিছু দেখা শোনা সবই আর কি ।আমার মেজ পিসেমশাই অর্থাৎ মৃদুলদি’র বাবা এই রান্নাবান্নার
তদারকির কাজ়ে নিজেকে একনিষ্ট
ভাবে নিযুক্ত
রাখতেন ।তখন নকুল ঠাকুরের মেজিয়া অঞ্চলে খুব নামডাক ছিল । সেই নকুল ঠাকুর আসত তার দলব্ল নিয়ে আমাদের
বাড়ি প্রায় সব কাজেই । তখন তো আর এখনকার মত ক্যাটারারদের এত ছড়াছড়ি ছিল না । রান্না
বান্না ভিয়েন সব কিছু বাড়িতে নিজেদেরকেই ক্রতে হত ।এমনও মনে
পড়ে আমার দিদির বিয়েতে মিষ্টির জন্য ছানা আনা হয়েছিল, কিন্তু সেই ছানা খারাপ হয়ে যাবার
জন্য মিষ্টি হয়নি, তাই মামা আবার পরের দিন বাঁকুড়া থেকে নিজে গিয়ে ছানা নিয়ে আসে ।শুধু
আমাদের বলেই নয়, মামাকে কারো কোন কাজেই না বলতে শুনিনি । খুব মনে পড়ে নন্দা’দির বিয়েতে
(আমার বড় জ্যাঠামশাই’এর একমাত্র
মেয়ে) বাবা সাধ্যাতীত ভাবে সহযোগিতা করেছিল বড় জ্যাঠামশাই’কে
। বাবার সাথে মামাও প্রাণ দিয়ে সাহায্য করেছিল
আমাদের পুরো পরিবারকে । সে কথা আজও সবাই মনে রেখেছি আমরা । পারুর বিয়েতে মামা পুরো
টিম নিয়ে বোকারো চলে গিয়ছিল । পুরুলিয়া’য় বাবাকে নিয়ে সব বাজার করা, সমস্ত কিছু ছিল
মামার দায়িত্বে ।১৯৬৯ সাল নাগাদ বাবা কাকাকে একটা ওষুধের দোকান করে দিয়েছিল গোপালমাঠে
। মামা এখানে থাকলে কাকার সাথে প্রায়ই চলে যেত ওষুধের দোকানে ।
খুব
মনে পড়ে বাবা হেডরাইটসনে চাকরি করা কালীন কি এক সখ হল বেশ
বড় আকারে একটা পোলট্রি ফার্ম করার । সখ যখন তখন বাবা তা চরিরার্থ করবেই । মাঝপুকুরের
পাড়ের উত্তর প্রান্তে ভাগাভাগির পর একটা জায়গা ঠিক হল পোলট্রি করার জন্য । দাদু এলেন, যথারীতি সব আদেশ উপদেশ দিলেন বাবাকে
তারপর শুরু হল উন্নত মানের এক পোলট্রি, সাথে বিশাল জায়গায় চাষাবাস । বাবা টাউনশিপের ভাল ভাল জায়গা থেকে উন্নত মানের মুরগি ছানা নিয়ে
এল । আমার ছোট পিসিমা’র বাড়ি থেকে (ইলামবাজার সন্নিকটে আকুলিয়া গ্রাম) দেশি মুরগি ও
হাঁসে ছানা নিয়ে এল গাড়িতে করে । এক নেপালি দা্রোয়ান রাখা হল দিবা রাত্রি সেখানে পাহারা
দেবার জন্য । বেশ উন্নত প্রথায় সব কিছুই চলছিল, কিন্তু লোকের অভাবে অত বড় প্রোজেক্টটা মার খেয়ে গিয়েছিল । তা মামার
কথায় আবার আসি । মামা, বাবা বা কাকার সাথে সন্ধ্যে বেলায় চলে যেত সেই পোলট্রিতে । বেশ কিছুক্ষণ
কাটিয়ে রাত্রে একেবারে সবাই ফিরে আসত বাড়িতে । মামার কথা খুব মনে পড়ে যেদিন পাড়ে আমাদের
মুরগি রান্নার আয়োজন হত, কিন্তু একান্ত গোপনে কারণ আমাদের বাড়িতে মুরগি রান্নার কোন
নিয়ম ছিল না, এখনো নেই । বেশ ভাল দেখে একটা মুরগি কাটা হত, তারপর সেটা রান্না করে বাড়িতে
খুব গোপনে নিয়ে আসা হত । সেই আনার দায়িত্ব থাকত মামার ওপর কারণ তখনও আমাদের এই গ্রামে
কোন বিদ্যুৎ আলোর ব্যাবস্থা ছিল না, তাই সেই অন্ধকারে মামাকে কেউ সহজে চিনতে পারবে
না, এই আশাতেই মামার উপর সেই গুরু দায়িত্ব বজায় থাকত । তারপর সেই মাংস আমরা সবাই মিলে,
আমাদের একটা চালা ঘর ছিল সেখানে বসে সব ভাই বোন বাবা, কাকা, মামা মিলে একসাথে বসে উপভোগ
করতাম । আমার মা কাকীমা কিন্তু কোনদিনই মুরগীর মাংস খেতেন না ।
মামার
আর একটা বিশেষ গুণ ছিল মামার হাতের লেখা । মুক্তোর মতো মামার হাতের লেখা ঝকঝক করতো
। মামার গ্রামের বা নিকট আত্মীয় কেউই কোন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পত্র আর ছাপাবার প্রয়োজন
মনে করতেন না, মামাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে কাজ সেরে নিতেন । যে কোন দরখাস্ত বা অন্য কোন
নথিপত্র সবই থাকত মামার হাতের লেখায় । এটা একটা মামার বিশেষ পরিচিতিও ছিল ।
আমার
মা প্রায়ই অসুখে ভুগতেন তাই সংসারের নানান কাজে সহায়তার জন্য বাবা মামাকে বলেছিলেন সেখান থেকে একটি
বিশ্বস্ত ছেলে দেখে দেবার জন্য । মামা তাই
পলাশী গ্রাম থেকে একদিন নিয়ে এল শ্যাম বলে একটি ছেলেকে – শ্যাম প্রামাণিক । বেশ ভাল
ছেলে ছিল । আমাদের বাড়িতে বেশ মানিয়ে নিয়ে বেশ কয়েক বছর ছিল । সব কাজ করত এবং বাবা,
মা, কাকা ও কাকীমা’র বেশ বাধ্য ছিল । আমার
বাবার দূরদর্শিতা ছিল একটু অন্যরকম । বাবা দেখলেন সুদূর বাঁকুড়ার এক গ্রাম থেকে এসে
আমাদের বাড়িতে কাজ করে তার কতটকুকুই বা পোষাবে । তাই বাবা বলল “শ্যাম তুই সংসারের
কাজ কাজ কর্মের পাশাপাশি গাড়ি চালানো শিখে নে ” । তখন তো
আমাদের বাড়িতে হেডরাইটসনের গাড়ি যাওয়া আসার কোনই কমতি ছিল না। বাবা এক ড্রাইভারকে বলে
শ্যামকে গাড়ি চালানো শেখার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন । বেশ শিখেও ছিল শ্যাম ।শুধু তাই নয়, বাবা শ্যামকে
রাতের বেলায় Mr. Tight বলে এক European সাহেবের বাংলোতে Night Guard এর কাজেও নিযুক্ত
করেদিয়েছিলেন । বাবা চিন্তা করেছিলেন যে এইভাবে যদি নানান কাজে তাদেরকে নিযুক্ত করে
বেশি পরেমাণে অর্থ উপার্জন করার সু্যোগ করে দেওয়া যায় তাহলে হয়ত সেই ছেলেগুলি আমাদের বাড়িতে মায়ের কাছে
থেকেই যাবে, আর আমাদেরও স্ংসারেরো সুবিধা হবে । শ্যাম অনেক দিনই আমাদের বাড়িতে ছিল । শ্যাম চলে যাবার
পর সতীশ বলে একটি ছেলেকেও আমাদের বাড়িতে থাকার জন্য মামা ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন ।
আসলে তারা প্রায় সবাই মামার ছাত্র ছিল কোন না কোন সময়, আর মামার কথা ফেলতে তারা কেঊই পারত না ।
মামার সংসার ও আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল । দেখতে দেখতে ছেলে
মেয়েরা সব বড় হয়ে উঠল । মামার একটি মেয়ে আর
চারটি ছেলে । মেয়েই বড় তারপর চার ছেলে । মামা প্রায়ই আসত আমাদের বাড়ি । দু-তিন থেকে
আবার চলে যেত, কারণ মামার স্কুল ছিল, ছুটি থাকলে বেশ কয়েক দিন হয়ত থেকে যেত । খুব মনে
পড়ে মামা ভাই ফোঁটার দিন আসত মায়ের কাছে ফোঁটা নিতে । আগেই পড়ত কালী পুজো । রানিগঞ্জের
কালী বাড়ীতে দায়ীত্বে থাকাকালীন কিছু মানুষের সাথে মামার আত্মীয়তা থাকার সুবাদে মামা
কালী পুজোর দিন ওখানে রাত্রে অখানেই থাকত আর তারপর দিন আমাদের বাড়ী আসত প্রচুর মিষ্টি
নিয়ে, আমরা সবাই মিলে তা খেতাম বেশ মজা করে । বাবা যখন বোকারোতে চাকরি করতেন মামা তখন
প্রায়ই ওখানে যেত, হাবলিও ওখানে বেশ কয়েক দিন মামার সাথে গিয়ে থেকে আসত । বেশ ভালই
কাটত আমাদের । আমি তখন মাইথনে চাকরি করতাম, আমিও সপ্তাহের শেষে চলে যেতাম মা বাবার
কাছে বোকারোতে আবার সোমবার কোলফিল্ড ধরে মাইথনে চলে আসতাম ।
বাবা
ও বেশ কয়েক বছর পর গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল । কোলকাতায় অপারেশন হল, মামা দেখতেও
গিয়েছিল । ১৯৮৩ সালে বাবা আমাদের ছেড়ে
চলে গেলেন । বাবা যখন দুর্গাপুরে চাকরি করতেন তখন মামার বড় ছেলে রাতুলকে একটা কোম্পানীতে
চাকরি করে দিয়েছিলেন । বেশ ভালই চলত, মামার ও একটা সাহায্য হত । ১৯৮৪ সালে, বাবা মারা
যাবার পর, হাবলির বিয়ে হল বাঁকুড়া জেলার কানুড়ি বলে একটা গ্রামে । কিন্তু খুব সচ্ছল
পরিবার ছিল না বলে মামার মনে একটা অশান্তি সারা জীবন দানা বেঁধে ছিল ।
আস্তে
আস্তে মামার সব ছেলেদেরও বিয়ে হয়ে গেল । তাদেরও সংসার বাড়তে
লাগল । মামারও বয়েস বাড়ল । মা’ও ১৯৯৪ সালে চলে গেলেন । তারপরও মামা এখানে
আসত আমাদের কাছে মাঝে মাঝে । মামা আমাকে খুবই ভালবাসতেন । পিকুর বিয়েতে মামা ও ফটিক
মামা দুজনে আমাদের বিয়েবাড়ি যেন আলো করে রেখেছিল
। পিকুর বিয়ের পর অতসীকে নিয়ে ইকড়াতেও গিয়েছিলাম । সবাই খুব আনন্দিত হয়েছিল । আস্তে
আস্তে মামার ও বয়েস বাড়তে লাগল । মামা আর আমরাই আসতে পারতেন না । আমি ও মঞ্জু
মাঝে মাঝে ইকড়া গিয়ে মামার সাথে দেখা করে আসতাম । এই ভাবে চলতে চলতে মামাও একদিন
আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২০১৮ সালে একাদশী’র দিন (৩১/১০/২০১৮) । মামা চলে যাবার পর মৃদুল’দি একা থেকে থেকে কেমন যেন নিরব
হয়ে গেল । এমনই মৃদুল’দি ছিল খুব শান্ত প্রকৃ্তির । বেশ
কয়েক মাস পর মৃদুল’দি আর কাউকে ঠিক ভাবে চিনতেও পারত না, কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল । তারপর ২০১৯
সালে ২৯শে ডিসেম্বর আমাদের ছেড়ে সে’ও চলে গেল । মামা বাড়ি একবারে ফাঁকা হয়ে গেল
চিরতরে । প্রাণ খুলে কথা বলারও কেউ থাকল না ।আমাদের প্রতি মামার ভালবাসা সে এক অধ্যায় । আজকের
দিনে সচরাচ্র দেখাই যায় না ।
ছোট
থেকেই মামা বাড়ির আদর আবদার যা পেয়েছি তা চির জীবন মনে রাখার মত । দাদু, দিদিমা, ফটিক
মামা, মামীমা, মামা ও মৃদুল’দি থাকা কালীন মামা বাড়ি গেলে মনে হতনা যেন আর বাড়ি আসি
।
এবার
বর্তমান পরিস্থিতিতে একটু আসি । প্রথমেই আসি গ্রামের তথা চারপাশের উন্নতির কথায় । এখন
আর মেজিয়া ঘাট হয়ে সেই নৌকায় করে যাবার দরকার পড়ে না । দরকার পড়ে না আর সেই গরুর গাড়ির
। এখন রানিগঞ্জ থেকে পাকা ব্রিজ হয়েছে বাঁকুড়া বা দুর্গাপুর আসা যাওয়ার জন্য । এখন আর দেখা যায় না রাস্তার দুপাশে সেই ছায়াঘন
গাছগুলি । এখন বিশাল চওড়া রাস্তা এমনকি মামা
বাড়ি যেতে এবার থেকে টোল ট্যাক্স দিয়ে যেতে
হবে । এবার আসি গ্রামের কথায় । বড় রাস্তার মোড় থেকেই গ্রাম পর্যন্ত এখন পাকা রাস্তা।
হাঁটু পর্যন্ত কাদা আর দেখাই যায় না । গ্রাম ঢোকার মুখেই তৈরি হয়েছে এক বিএড কলেজ,
বিশাল জায়গা জুড়ে । মামা যে স্কুলটিতে তার জীবন কাটিয়ে গেছেন সেটি এখন পাকা বিল্ডিং
হয়েছে । এসেছে বৈদ্যুতিক আলো । আগের মত এখন কেউই আর সন্ধ্যের আলোয় রাত্রের খাবার খেয়ে নেয় না । এখন
আর কেউ জোড়ে কলসি নিয়ে খাবার জল আনতেও যায় না । এখন সরকার থেকে বহু নলকূপ বসান হয়েছে
।অফুরন্ত জল । তাছাড়া বহু বাড়িতে এখন নিজেরা সাব মার্সিবল কল বসিয়ে নিয়েছে । এখন আর
নারী পুরুষ কাউকেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে জোড় বা কোন পুকুরে যেতে হয় না । এখন বাড়িতে
বাড়িতে পায়খানা, আধুনিক মানের বাথরুম । সবার পকেটেই রয়েছে মোবাইল ফোন । বাড়িতে বাড়িতে
টেলিভিশন, কেবল লাইন, এমনকি বাতানুকূল যন্ত্রও । প্রায় সব বাড়িতেই রয়েছে দু-চাকার গাড়ি, চার চাকার গাড়িও কিছু কম নয় । দূর্গামন্দিরটিও
বেশ আধুনিক মানের হয়েছে । একটি শিব মন্দিরও তৈরি হয়েছে ।অদূরে স্থাপিত হয়েছে ডিভিসির
তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র । রাতের বেলার তীব্র আলোর ঝলকানিতে চাঁদের আলোও ম্লান হয়ে যায়
। সব মিলিয়ে বেশ ভালই লাগবে । কিন্তু সামগ্রিক
উন্নতি আমার চোখে সেরকম কিছু একটা চোখে পড়ে না ।দেখা যায় না বা শোনা যায় না গ্রামের কোন ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ নজর
কাড়া রেজাল্ট, বা কারো চাকরিতে বিশেষ পদমর্যাদা বা উন্নতির কথা । না শোনা যায় কোন ছেলে মেয়ের নৃ্ত্য
বা সঙ্গীতে পারদর্শিতার কথাও ।
যাই
হোক তবুও আমার মামার বাড়ি । এখন আমাদের যথেস্ট বয়স হয়েছে । আমাদের আদর করার মত মানুষ
আর সেখানে পাওয়া যাবে না । এখন মামীমাকে বাদ দিলে আমরাই সিনিয়র, তাই আদর আব্দারের চেয়ে
দায়িত্ব বা কর্তব্যের ভারই বেশি । তবে সেই আগের পরিবেশ বা পরিস্থিতি এখন আর নেই । মামাতো
ভাইরা সব যে যার মত থাকার ব্যাবস্থা করে নিয়েছে । তাদের নিজের নিজের সংসার নিয়ে তারাও
ব্যাস্ত । ছেলে মেয়ে মানুষ করার এবং নানান ভাবে অর্থ উপার্জনের তাগিদে তারাও আপ্রাণ
চেষ্টা চালিয়ে যাছে ।
মামার
বাড়ির প্রতি আমার ছোট থেকেই একটা টান বা দুর্বলতা আছে । তাই যত দিন বেঁচে থাকব মামার
বাড়ির সবার সাথে সুসম্পর্ক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাব ।
---------------------------------
।
No comments:
Post a Comment