Saturday, 29 March 2025

 

 

তাল নিয়ে দু চার কথা

         -     কাঞ্চন কুমার চট্টোপাধ্যায়

অবসর জীবনের এখন একটি গুরত্বপূর্ণ কাজ হল সকালেই দুধ আনতে যাওয়া ।  আমার পাড়ার নিকটবর্তী একটি বাড়িতে আমি প্রতিদিন সকালেই হাজির হই খাঁটি দুধের জন্য । বেশ কয়েক বছর ধরেই যাচ্ছি সেখানে এই দুধ আনতে । আজ সকালে গিয়ে দেখি উঠোনের এক জায়গায় স্তূপিকৃত তাল আঁটির আঁকুরগুলি খাবার পর  ফেলে দেওয়া অংশ  বিশেষ যা জ্বালানী হিসাবে ব্যাবহৃত হবে ।এই আঁকুর দেখেই আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল । আমি জিজ্ঞেস করলাম এত আঁকুর কোথায় পাওয়া গেল । সে খুব আনন্দেই আমাকে বলল, “তুমি আঁকুর খেলে আমি কালই তোমার বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব” । আমি খুব খুশিই হলাম । ছেলেবেলায় আমরা সব দিদি, বোনরা মিলে এই আঁকুর খেতে এত ভালবাসতাম যে কি বলব ! শহরাঞ্চলের মানুষেরা হয়ত এই আঁকুর কি জিনিস জানেনই না, আবার কেউ কেউ হুয়ত বা জানেন । যাই হোক আমি এই অবসরে একটু আঁকুরের সম্বন্ধে পরিচিতি দিই । ভাদ্র মাসে পাকা তালের কথা আমরা তো সকলেই জানি । সেই পাকা তালের মাড়িটি  নিয়ে নেওয়ার পর যে আঁটিগুলি  বের হয় সেগুলি মাটিতে কোন  একটা জায়গায় রেখে দিতে হয় । কোন কিছুই করার দরকার পড়ে না । মাটির সংর্স্পশে এলেই হল । তারপর বষার জল তার ওপর পড়লেই সেই তাল আঁটিগুলির থেকে অঙ্কুর বের হয় । এই অঙ্কুর থেকেই এসেছে আঁকুর কথাটি । সেই অঙ্কুর মাটির সংর্স্পশে এসে গাছের জন্ম নিতে থাকে, ভিতরে ভিতরে , যেমন করে যে কোন বীজ থেকে  অঙ্কুর বের হয়ে গাছ হয় ।তার পর এই আশ্বিন-কার্তিক মাসে সেই আঁটিগুলি মাটি থেকে তুলে নিয়ে এসে দুভাগ করে কাটা হয় । বের হয় এক নরম বীজ, সেটাই গ্রামাঞ্চলে আঁকুর নামে পরিচিত । আঃ কি তার স্বাদ, কি তার মিষ্টতা । প্রকৃতির যেন এক অপূর্ব সৃস্টি ।  আমি যখন চাকরি করতাম তখন আমাদের ব্যক বেঞ্চ বলে একটা গোষ্ঠি ছিল । সেই গোষ্ঠিতে আমার এক বিশেষ বন্ধু ছিল – রন্তিদেব সরকার । লাল মাটির দেশের মানুষ ছিল, কিন্তু তার বিচরণ ছিল শান্তিনিকেতন  তথা মহানগরীর আনাচে কানাচে জ্ঞানীগুণীজনদের মহলে তার কবিতা ও সাহিত্যের সুত্র ধরে । খুব গুণী মানুষ । আর এক ভাই’এর মতোই বন্ধু ছিল কাজল তিওয়ারী অগাধ জ্ঞান ছিল তার প্রায় সব ব্যপারেই । সেই  গোষ্ঠিতে আমাদের মধ্যে এই হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারগুলো নিয়ে খুব আলোচনা হত । আর আমাদের মধ্যে যারা একটু শহর  থেকে আসা ছিল, তারা এসব শুনে অবাক হয়ে যেত । যাই হোক আঁকুর সম্বন্ধে তো অনেক আলোচনাই হল এবার এই তালের সম্বন্ধে আরও দু-চার কথা এখানে বললে কিছু ক্ষতি হবে না । প্রথেমেই বলি তাল শাঁসের কথা । যদিও তাল শাঁসের স্বাদের কথা আমাদের প্রায় সবারই জানা । প্রখর গ্রীষ্মে  ওই রকম একটি সুস্বাদু খাবার কে না চায় । আমরা তখন খুবই ছোট,  সেই কচি তাল আমাদের বাড়িতে আমাদের চাষী  কেটে দিত আমাদের খাবার জন্য । সেই কচি তাল শাঁসের ভিতর আঙ্গুল  ঢুকিয়ে সেটাকে বের করে একদম মুখের ভিতর চালান করে তার স্বাদ গ্রহণ করার যে কি মজা তা এখন আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি । যদিও এখন প্রখর গ্রীষ্মে এই তাল শাঁস গ্রামাঞ্চল থেকে এনে বিক্রি করতে আসে নানান জায়গায় ।  মাঝে মাঝে তাই আমরা খেতে পাই এখনো । কিন্তু তখন আমরা আবার  সেই তাল শাঁস খাবার পর যেটা করতাম সেটা হয়ত শহরাঞ্চলের মানুষ ভাবতেই পারবেন না । সেই তাল শাঁসগুলি

খাবার পর সেই তালের খোলাটির  মধ্যবর্তী জায়গায় একটি সরু বাঁশের কঞ্চি ঢুকিয়ে আমরা গাড়ি বানাতাম । আর তাই নিয়েই চলত আমাদের সবার খেলাধুলা । সে ছিল এক দারুণ মজার ব্যাপার      এছাড়া তাল খেগুরের রসের মাদকতা আর কে না জানে । আমরা ছোটবেলায় যদিও তাল রস খুব একটা খাই নি কিন্তু তখন দেখতাম একধরনের লোক এই তাল গাছে উঠত রস পাড়ার জন্য । আমরা গ্রামাঞ্চলে আমরা তাদের পাশিওয়ালা বলতাম । সাধারনত তারা দেখতে হত বেশ সুঠাম চেহারার, তেল চকচকে কালো গায়ের রং । পায়ে একধরনের বেল্টের মত জিনিস পরত (গাড়ির ফ্যান বেল্টের মত দেখতে) গ্রামাঞ্চলে  সেটাকে  ফাঁদ বলে । তৈরি হত বেঁতি দিয়ে ।  ( তাল গাছের পাতার গোঁড়ার অংশের ছাল থেকে বানানো হয় ) । সেটা পরে তর তর করে উঠে যেত সেই তাল গাছের একদম মাথায় । সেখানে গাছ চেঁছে সমস্ত তৈ্রি করে রসের হাঁড়ি টাঙ্গিয়ে আসত আবার রস ভর্তি হাঁড়ি নামিয়েও আসত ।প্রখর গ্রীষ্মে সেই তাল রস যে কি মিষ্টি লাগত,  তা না খেলে বোঝানো যাবে না ।  তাল রস থেকে আবার  তাড়ি হত যা অনেকেই খেত ।  এছাড়াও তাল রস জ্বালিয়ে গুড়, পাটালি  বা  তাল মিছরিও তৈ্রি হত যা সত্যি  খুবই সুস্বাদু ।

আমরা কিন্তু তখন খেজুর রস খুব খেতাম । আমাদের পুকুরের পাড়ে প্রচুর খেজুর গাছ ছিল বা এখনও আছে । তখন শীত পড়লেই মহলদাররা চলে আসত । আমাদের সাথে কথাবার্তা বলে শুরু করত তাদের ব্যাবসা । বিনিময়ে আমাদের খেজুর গুড়, পাটালি ও মাঝে মাঝে খেজুরের রসও দিত । সে রসের কি মিস্টতা তা আর বলে বোঝানো যাবে না। খেজুর রস কিন্তু সূর্য ওঠার আগেই গাছ থেকে নামিয়ে আনতে হয় নইলে তার সেই স্বাদ আর থাকে না । ছোটবেলায় শুনতাম আমার কাকা সেই মহলদারকে বলত ‘জিরেন কাঠির রস’ দিতে । তখন  জিরেন কাঠি কি জিনিস জানতাম না বা জানার চেস্টাও করিনি । জিরেন কাঠির রস খুব মিস্টি হয় অন্য দিনের রসের থেকে । জিরেন কথাটা এসেছে জিরিয়ে নেওয়া বা বিশ্রাম নেওয়ার থেকে । একটি নির্দিষ্ট  খেজুর  গাছ থেকে   বেশ কয়েক দিন রস  নেবার পর  কিছুদিন বিশ্রাম দিতে হয় । তারপর আবার নতুন  করে গাছটি চেঁছে আবার রস নেওয়াকে জিরেন কাঠির রস বলে ।  এখনও আমাদের এখানে মহল বসে, এখনও খেজুর গাছ থেকে সেই একই ভাবে সেইরকমই রস পাওয়া যার, কিন্তু আমাদের আর খাওয়া হয় না । হয় সময়ের অভাব, নয়ত বা সেই সু্যোগের অভাব নয়ত বা শারিরীক প্রতিবন্ধকতা, এই আর কি । এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা তো এই সবের স্বাদ থেকে একবারেই বঞ্চিত   

          তাল শাঁস,  তাল রস বা তালের পাটালির কথা তো অনেক বললাম । এবার তাল গাছ সম্বন্ধে দু-চার কথা বলি । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ছড়াটি আমরা তো সবাই  পড়েছি ।  'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।'  তালের ইংরেজি নাম Palmyra palm তালের জন্ম কিন্তু মধ্য আফ্রিকায়। মানুষের মতো তালগাছেরও মেয়ে গাছ আর ছেলে গাছ আছে। ছেলে গাছের মাথায় লম্বা লাঠির মতো জটা হয়, কোনো ফল হয় না; মেয়ে গাছে ফল হয়- অর্থাৎ তাল ধরে।  তাল গাছ নানান ভাবে ব্যরহার করা হয় ।  তালগাছের থামের মতো বয়স্ক কাণ্ড করাত দিয়ে চিরে তালকাঠ বানানো হয়। তালকাঠ খুব মজবুত দীর্ঘস্থায়ী। টিন বা টালির  ঘর বানাতে রুয়ো-বাতা হিসেবে তালকাঠ ব্যবহার করা হয়তালপাতা দিয়ে ঘরও বানানো যায়। আমাদের গ্রামাঞ্চলে বা আরও বহূ জায়গায়  গরিব মানুষেরা তালপাতা দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকে। ঘরের ছাউনি, বেড়া- সবই তালপাতা দিয়ে হয়তালপাতা দিয়ে আবার  বাঁশিও বানানো হয় । সেই গানটা  তো আমাদের এখনো খুবই মনে পড়ে - 'আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি’।  প্রাচীন কালে তো কাগজ ছিল না তাই তালপাতাতেই লেখা হত । এখনো আমাদের দূর্গাপুজোর সময় হোমের সময় যে চণ্ডী থেকে পাঠ হয়, সেই পুঁথিটি তালপাতাতেই লেখা । তার বয়স প্রায় ৩০০ বছর ।   তালপাতার পুঁথি এখনো অনেক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছেকাগজ আবিষ্কারের আগে কয়েকটা তালপাতা বেঁধে খাতা বানানো হতো। তাতে কঞ্চির কলম দিয়ে লেখা হতো।  

পাকা তালের আঁটির ভেতর নারকেলের মতো যে শাঁস হয় তা কেউ কেউ শুকিয়ে কুচি কুচি করে কেটে পানের সঙ্গে সুপারির মতো খায়। একে বলে তালসুপারি ।  তালগাছের পাতা রোদে শুকিয়ে তারপর বানানো হয় পাখা। তীব্র গরমে তালপাখার শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায় । হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেলে তাল পাতার পাখাই আমাদের আরাম দেয় ।   বাঁশের কাঠির ফ্রেমে তালাপাতা মেলে দিয়ে বানানো হয় তালপাখা। একেকটি তালপাতায় চার থেকে পাঁচটি পাখা হয়  সেই পাখা তৈ্রি করে কত মানুষ তাদের সংসার চালিয়ে যাচ্ছে এখনও ।

 

তালের প্রবাদ বাগধারাও অনেক আছে। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে অনেক সময় বলে 'তালপুকুর' তাল শব্দটি বড় অর্থে ব্যবহৃত হয়। তার মানে তালপুকুর হবে বড় কোনো পুকুর বা দীঘি। কিন্তু বিদ্রূপ করে অনেক সময় বলা হয়, ঘটি ডোবে না আবার তার নাম তালপুকুরআরও  হু কথাই শুনি আমরা এই তাল কথাটি থেকে যেমন - তিল থেকে তাল এর অর্থ সামান্য বিষয়কে বড় করে তোলাতালপাতার সিপাই এর অর্থ রুগ্ণ বা ছিপছিপে। কেউ রোগা হলে তাকে বলা হয় তালপাতার সিপাইতালগাছের আড়াই হাত এর অর্থ কষ্টকর বা কঠিন কাজ। তালগাছে যারা ওঠে তারা জানে, এর মাথার আড়াই হাত ওঠা কত কষ্টকরতালকানার অর্থ কাণ্ডজ্ঞানহীন। অনেক সময় আমরা কোনো বোকাসোকা লোককে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলে এই প্রবাদ বাক্যটি ব্যবহার করিতালগোল পাকানোর অর্থ বিশৃঙ্খলা। যখনই কোনো কাজ করতে নেমে তা সুচারুভাবে করা যায় না বা কাজটা যেভাবে হওয়া উচিত ছিল সেভাবে হয় না, তখনই আমরা এই প্রবাদ বাক্যটি ব্যবহার করি

 

যাই হোক তাল গাছ নিয়ে  অনেক কথাই লেখা হল, এবার এখানে  ইতি টানছি  নইলে সনৎ সিংহের গানের মত  আমিও “তালে তালে পা ফেলে আবার বেতালা হয়ে যাব”

 

                                                      --X--

 

 

 

                   

 

No comments:

Post a Comment